কোরআনের কয়েক জায়গায় দাবি করা হয়েছে, এটি এমন এক গ্রন্থ যার অনুরূপ কেউ কখনো রচনা করতে পারবে না। একইসাথে, আল্লাহ তার নিজের অস্তিত্বের সপক্ষে কোন অবজেটিভ প্রমাণ না দিয়ে তাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার জন্য হুমকিধামকি দিয়ে, যারা ঈমান আনেনি, তাদের উদ্দেশ্যে একটি 'লেখার আহ্বান' জানিয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা এই দাবীটি বিশ্লেষণ করবো, এবং দাবীটির মধ্যে কী কী লজিক্যাল ফ্যালাসি রয়েছে তা স্পষ্টভাবে বোঝার চেষ্টা করবো। উল্লেখ্য, এই দাবীটি নানা সময়ই মুসলিমদের পক্ষ থেকে নাস্তিকদের রীতিমত চ্যালেঞ্জের সূরে বলা হয়।
এই আয়াতে কোরআনের ঐশী উৎস নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকলে একটি অনুরূপ সূরা রচনার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সহায়তাকারী হিসেবে ডাকতে বলা হয়েছে যাচাইয়ের শর্তস্বরূপ। (( কোরআন, ২ঃ২৩ ))
আমি আমার বান্দাহর প্রতি যা নাযিল করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার মত কোন সূরাহ এনে দাও আর তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহবান কর।
— Taisirul Quran
এবং আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, যদি তোমরা তাতে সন্দিহান হও তাহলে তৎসদৃশ একটি ‘‘সূরা’’ আনয়ন কর এবং তোমাদের সেই সাহায্যকারীদেরকে ডেকে নাও যারা আল্লাহ হতে পৃথক, যদি তোমরা সত্যবাদী হও!
— Sheikh Mujibur Rahman
আর আমি আমার বান্দার উপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি সূরা নিয়ে আস এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।
— Rawai Al-bayan
আর আমরা আমাদের বান্দার প্রতি যা নাযিল করেছি তাতে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকলে তোমরা এর অনুরুপ কোনো সূরা আনয়ন কর [১] এবং আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের সকল সাক্ষী-সাহায্যকারীকে [২] আহ্বান কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও [৩]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
পূর্বের চ্যালেঞ্জের পর যদি কেউ কোরআনের অনুরূপ কিছু রচনা করতে না পারে—যা তারা কখনোই পারবে না—আল্লাহ এখানে নিজেই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে ফেলেছে এবং হুমকি দিচ্ছে। তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তির ভয় প্রদর্শন করা হয়েছে, যেখানে মানুষ ও পাথর হবে আগুনের ইন্ধন (( কোরআন, ২ঃ২৪ ))
যদি তোমরা না পার এবং কক্ষনো পারবেও না, তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, যা প্রস্তুত রয়েছে কাফেরদের জন্য।
— Taisirul Quran
অতঃপর যদি তোমরা তা করতে না পার এবং তোমরা তা কখনও করতে পারবেনা, তাহলে তোমরা সেই জাহান্নামের ভয় কর যার খোরাক মনুষ্য ও প্রস্তর খন্ড - যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
— Sheikh Mujibur Rahman
অতএব যদি তোমরা তা না কর- আর কখনো তোমরা তা করবে না- তাহলে আগুনকে ভয় কর যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর, যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য।
— Rawai Al-bayan
অতএব, যদি তোমরা তা করতে না পারো আর কখনই তা করতে পারবে না [১], তাহলে তোমরা সে আগুন থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর [২], যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে [৩] কাফেরদের জন্য।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
এই আয়াতে কোরআনের অনন্যতা নিয়ে একটি সর্বজনীন ও চূড়ান্ত দাবি করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে—মানব ও জ্বিন মিলেও যদি চেষ্টা করে, তবুও তারা কোরআনের অনুরূপ কিছু আনতে পারবে না, যত সহযোগিতাই তারা একে অপরকে করুক না কেন। (( কোরআন ১৭ঃ ৮৮ ))
বল, ‘এ কুরআনের মত একখানা কুরআন আনার জন্য যদি সমগ্র মানব আর জ্বীন একত্রিত হয় তবুও তারা তার মত আনতে পারবে না, যদিও তারা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করে।’
— Taisirul Quran
বলঃ যদি এই কুরআনের অনুরূপ কুরআন রচনা করার জন্য মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর অনুরূপ কুরআন রচনা করতে পারবেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman
বল, ‘যদি মানুষ ও জিন এ কুরআনের অনুরূপ হাযির করার জন্য একত্রিত হয়, তবুও তারা এর অনুরূপ হাযির করতে পারবে না যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়’।
— Rawai Al-bayan
বলুন, ‘যদি কুরআনের অনুরুপ কুরআন আনার জন্য মানুষ ও জিন সমবেত হয় এবং যদিও তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর অনুরুপ আনতে পারবে না।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria
এই দাবিটি ইসলামি বিশ্বাসের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হলেও, যুক্তিবাদের আলোকে বিশ্লেষণ করলে এটি বহু লজিক্যাল ফ্যালাসিতে পরিপূর্ণ। আমরা ধীরে ধীরে সবই এখানে আলোচনা করবো।
: “ৎ ঋ ড়”
: এটা কি কিছু হলো নাকি? এর অর্থ কি? হাবিজাবি কিছু বললেই হয়?
: আচ্ছা, আলীফ লাম মীমের অর্থ কি?
: এর অর্থ শুধু এর লেখক পরম করুনাময় জানেন।
: “ৎ ঋ ড়” এর অর্থও এর লেখক(আমি) জানেন, কিন্তু গুপ্তজ্ঞান বিধায় আপনাকে বলা যাচ্ছে না।
এই চ্যালেঞ্জকে অনেক সময় ইসলামের পক্ষ থেকে একটি মুক্ত, সাহসী ও যুক্তিনির্ভর চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়—যেন কেউ চাইলে কোরআনের সমতুল্য কিছু লিখে নিয়ে আসতে পারে, আর তারপর তা যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। বাস্তবে বিষয়টি আদৌ এতটা নিরাপদ বা মুক্ত নয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনো দেশে বসে কেউ যদি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন—অর্থাৎ কোরআনের অনুরূপ একটি সূরা বা আয়াত রচনা করে উপস্থাপন করেন—তাহলে তার বিরুদ্ধে অবিলম্বে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ ওঠবে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, সৌদি আরব বা ইরান—এইসব দেশে এমন কাজ করলে রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রেফতার, কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়। আরও ভয়াবহ হচ্ছে, এইসব দেশে আইনকে অপেক্ষা করে ‘ঈমানদার তৌহীদী’ জনতা নিজেরাই বিচার করে বসে। গুজব, সামাজিক মিডিয়া, ইমামদের বক্তৃতা—সব মিলিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সেই ব্যক্তিকে ‘মুরতাদ’ বা ‘ব্লাসফেমার’ আখ্যা দিয়ে গলা কেটে ফেলার হুমকি তো বটেই, বাস্তবে হত্যা করতেও পিছপা হবে না। এই বাস্তবতা কেবল ভাবনার বিষয় নয়, বরং শত শত বাস্তব ঘটনার প্রামাণ্য ফলাফল—যেখানে 'চ্যালেঞ্জ' শুধু মুখের কথা, কিন্তু তার পরিণতি মর্মান্তিক।
ধরুন আপনাকে চ্যালেঞ্জ দিলাম আপনি আমার সাথে দৌড়ে পারবেন না। এরপরে আপনার সাথে দৌড়াতে শুরু করলাম। আপনি দৌড় দেয়া মাত্রই আপনার পায়ে গুলি করলাম। এরপরে নিজেই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করলাম। এরকম দৌড় প্রতিযোগীতা কেমন হবে? আসুন একটি ভিডিও ক্লিপ দেখি,
কেউ যদি ইউরোপ, আমেরিকা বা কানাডার মতো তুলনামূলক মুক্ত ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেও বসে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন, তবুও তিনি নিরাপদ নন। ইসলামি মৌলবাদীরা এই বিষয়টিকে ‘বিশ্বব্যাপী ঈমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে দেখে। সালমান রুশদি, কার্টুনিস্ট লার্স ভিল্কস, স্যামুয়েল প্যাটি, অথবা ফ্রান্সের "শার্লি হেবদো" পত্রিকার উপর চালানো হামলার ঘটনা তারই ভয়ংকর উদাহরণ। এদের সবাই কোনো না কোনোভাবে ইসলামি বিশ্বাস, নবী বা কোরআনের সমালোচনা করেছিলেন—এবং কেউ কেউ হত্যা হয়েছেন, কেউ প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গু হয়েছেন, গোপনে জীবন কাটাচ্ছেন, বা নিরাপত্তার মধ্যে বন্দি জীবন যাপন করছেন। কোরআনের ‘তুলনাহীনতা’কে চ্যালেঞ্জ করা মানে বহু মুসলিমের চোখে “আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ”, যার জন্য তারা ‘কুফরি’ দোহাই দিয়ে হত্যাকেও ন্যায্য মনে করে। তাই এই তথাকথিত মুক্ত চ্যালেঞ্জ বাস্তবে এক ভয়ঙ্কর ফাঁদ, যার ভেতর ঢুকলেই মুক্তচিন্তার মানুষের উপর নেমে আসে সহিংসতার বর্বরতম পরিণতি।
চ্যালেঞ্জের প্রকৃতি এমন হওয়া উচিত, যেখানে উভয় পক্ষ যুক্তি ও প্রমাণ নিয়ে নিরপেক্ষ বিচারকের সামনে দাঁড়ায়, এবং বিচারপ্রক্রিয়ার পর বিজয়ী নির্ধারিত হয়। কিন্তু কোরআনের তথাকথিত অলৌকিকতা প্রমাণের চ্যালেঞ্জটি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে আল্লাহ বলে দাবি করা সত্তা নিজেই প্রথমে বলেন, “এর মতো কিছু রচনা করে দেখাও,” এবং এরপর পরবর্তী আয়াতেই তিনি ঘোষণা করে দেন—“তোমরা তা কোনোদিনই পারবে না।” অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়ায় যাওয়ার আগেই তিনি নিজেকে বিজয়ী ঘোষিত করেছেন। এটি এমন এক খেলায় পরিণত হয়েছে যেখানে একজন খেলোয়াড় বলছেন, “আমি জিতেই গেছি, কারণ তুমিই কখনোই জিততে পারবে না।” অথচ অপর খেলোয়াড়কে খেলায় নামার সুযোগ দেওয়া হয়নি, কোনো নিরপেক্ষ রেফারি নেই, এবং খেলাধুলার নিয়মও ঠিক করে দিয়েছেন খেলোয়াড় নিজেই।
এধরনের চ্যালেঞ্জ যুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে একেবারেই হাস্যকর এবং অসার। কারণ যখন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার পরপরই চ্যালেঞ্জদাতাই বিচারক, রেফারি ও বিজয়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তখন সেটি আর চ্যালেঞ্জ নয়—বরং আত্মঘোষিত সর্বশ্রেষ্ঠত্বের এক প্রতীক। এটি এমন এক ঘোষণার মতো—“আমি ভুল হতে পারি না, কারণ আমি বলেছি আমি ভুল নই।” এই আচরণ যুক্তিতে পড়ে Circular Reasoning এবং Begging the Question নামক ফ্যালাসির মধ্যে, যেখানে প্রমাণ না দিয়েই নিজের কথাকেই প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানো হয়। তাই বলা যায়, এই ধরনের চ্যালেঞ্জ আসলে কোনো পরীক্ষার আহ্বান নয়, বরং একধরনের আত্মরক্ষামূলক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কৌশল, যেখানে প্রশ্ন করলেই অবমাননা, আর ব্যর্থ হলেই জাহান্নাম—এমন ভয় দেখিয়ে যুক্তির পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়।
কোরআনের মতো কিছু রচনা করার চ্যালেঞ্জটি মূলত একটি অস্পষ্ট ও সংজ্ঞাহীন মানদণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্ন হলো — "এর মতো" বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? কোরআনে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে কোন দিক নির্দেশনাও দেয়া হয়নি, কোরআনের মত বলতে এখানে কী বোঝানো হয়েছে। কোরআনের মত বলতে আসলে কী বোঝানো হয়েছে, সেটি সম্পর্কে নানা মুসলিম নানা ধরনের ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিতে পারে। কিন্তু যিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন, চ্যালেঞ্জটির ক্রাইটেরিয়াগুলো ঠিক করে দেয়ার দায়িত্ব তারি ওপর বর্তায়। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে অন্য কেউ যদি চ্যালেঞ্জের ক্রাইটেরিয়া ব্যাখ্যা করে দিতে চায়, তা কোনভাবেই চ্যালেঞ্জের ক্রাইটেরিয়া বলে বিবেচিত হতে পারে না। এই চ্যালেঞ্জের ক্রাইটেরিয়াগুলো কোন বিষয় বা বিষয়সমূহের ওপর হবে?
যদি বলা হয়, কোরআনের মতো কিছু কেউ রচনা করতে পারবে না, তাহলে প্রথম প্রশ্ন আসে—এই "মতো" হওয়া বা না-হওয়ার মানদণ্ড কে ঠিক করবে? এই বিষয়ে বিচারকের ভূমিকা কে পালন করবে? সাধারণ মুসলিম? কোনো ভাষাবিদ? কোনো ধর্মবিশ্বাসী? কিন্তু এদের প্রত্যেকেই তো সীমাবদ্ধ, পক্ষপাতদুষ্ট এবং একে অপরের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে দ্বিমতপূর্ণ। এক মুসলিম আলেম যেটিকে “কোরআনের মতো নয়” বলবেন, এক মানবতাবাদী লেখক হয়তো সেটিকেই অধিকতর উন্নত বলে মনে করবেন। যেমন কেউ যদি বলেন, “ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে নিকৃষ্ট বলা অনৈতিক”—তাহলে সূরা ৯৮:৬ ("...তারাই সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট") এবং একজন যুক্তিনিষ্ঠ লেখকের লেখা মানবিক আয়াত ("সব মানুষ সমান, ধর্মে বিভেদ কোরো না")—এই দুটির তুলনায় কোনটি উত্তম, তা কি একজন মানুষের বিচারসীমার বাইরে নয়? পক্ষপাতহীনভাবে এটির বিচার করার জন্য প্রয়োজন এমন একটি সত্তা, যে কিনা নিরপেক্ষ, অলৌকিক, এবং পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। তাহলে আল্লাহ বনাম নাস্তিকের এই চ্যালেঞ্জে আরেকটি নিরপেক্ষ সত্তার প্রয়োজন, যিনি সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন ভাবে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারবেন।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসে—যদি কোরআন আল্লাহর বাণী হয়, তাহলে এই চ্যালেঞ্জের মানদণ্ড কি মানুষ নির্ধারণ করতে পারে? তা তো হওয়া উচিত আল্লাহর পক্ষ থেকেই সুস্পষ্ট ও নির্ভুলভাবে নির্ধারিত। অথচ কোরআনে এই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেও, সেখানে "তুলনীয়তা"র পরিমাপ, বিচারপ্রক্রিয়া বা গ্রহনযোগ্যতার ক্রাইটেরিয়া কোথাও স্পষ্ট করা হয়নি। এমনকি যারা মূল্যায়ন করবে, তাদের যোগ্যতা নিয়েও কিছু বলা হয়নি। সুতরাং অন্য কোনো মানুষের মতামতই এখানে শেষপর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হবে না। ধার্মিকদের দাবী হচ্ছে মানুষের জ্ঞান যেহেতু সীমাবদ্ধ, তাই মানুষ ঈশ্বরিক অনেককিছুই বোঝে না। সেই হিসেবে মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে আল্লাহর কোরআনের মানদণ্ড নির্ধারণ কীভাবে সম্ভব? আর সেটি করা হলেও, আল্লাহ তা মানবে এরকম তো কোন গ্যারান্টি নেই। দেখা গেল, কোন মানুষের মানদণ্ড মেনে কোরআন লিখিত হলো, এরমধ্যে আরেক মুসলিম এসে বলতে লাগলো, ঐ মুসলিমরা সহিহ মুসলমান নহে। তাহলে কী হবে? সব মুসলিম কী এই বিষয়ে একমত যে, ঐ মানদণ্ডগুলোই তাদের সকলের মানদণ্ড? আর দাবি যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে থাকে, তাহলে এই চ্যালেঞ্জের সার্থকতা বজায় রাখতে আল্লাহরই উচিত ছিল স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া—"এই এই বৈশিষ্ট্য পূরণ করলে তা কোরআনের মতো বিবেচিত হবে, এবং এই এই নিরপেক্ষ বিচারকের কাছে যাচাই করতে হবে।" কিন্তু এমন কোনো সংজ্ঞা বা পদ্ধতির অভাবে পুরো চ্যালেঞ্জটি একপাক্ষিক, অনির্ধারিত, এবং মূলত আত্মঘোষণামূলক এক কৌশলে পরিণত হয়েছে।
যেকোনো প্রতিযোগিতা বা বিতর্কের ভিত্তিমূল্যই হলো একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, যেখানে খেলার নিয়মাবলি দুই পক্ষের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত হয়, এবং তৃতীয় পক্ষ নিরপেক্ষভাবে সেই নিয়ম প্রয়োগ ও বিচারকার্য সম্পাদন করে। যেমন কোনো খেলায় দুই দলের প্রতিযোগিতা হলে, নিয়ম বানিয়ে দেয় না খেলোয়াড়দের কেউই। বরং সেই নিয়ম ঠিক করে স্বাধীন রেগুলেটরি সংস্থা বা নিরপেক্ষ রেফারী, যাতে উভয় পক্ষ ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারে। কিন্তু কোরআনের এই তথাকথিত "তুলনীয়তা চ্যালেঞ্জে" এই ন্যূনতম নৈতিকতা পর্যন্ত মানা হয়নি। এখানে আল্লাহ নিজেই খেলোয়াড়, তিনিই রেফারী, আবার তিনিই আগেই বলে দিয়েছেন তিনি জিতেই গেছেন। এমন পরিস্থিতিতে আর যাই হোক, সেটাকে চ্যালেঞ্জ বা প্রতিযোগিতা বলা যায় না—বরং সেটি এক তরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার অপকৌশল মাত্র।
এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে—খেলার নিয়ম বিষয়ে উভয় পক্ষের সম্মতি ও মতামত। খেলার নিয়ম যদি একপাক্ষিক হয়, এবং সেই নিয়মে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী অপর পক্ষকে বলেই বসে, “এই নিয়ম মেনে খেলো, আর হেরে যাও,”—তাহলে সেটা আসলে একটি প্রতিযোগিতা নয়, বরং নিরাপত্তাহীন, কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের প্রকাশ। যুক্তির খেলায় ন্যায্যতা মানে একসাথে বসে খেলোয়াড়দের সম্মতিতে নিয়ম তৈরি করা, যার ব্যত্যয় হলে পুরো খেলার বৈধতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। কোরআনের চ্যালেঞ্জ তাই প্রকৃত অর্থে কোনো যুক্তিপূর্ণ আহ্বান নয়, বরং একধরনের বিশ্বাসনির্ভর দাবির খাঁচা, যেখানে আপত্তি করলেই সেটি ঈশ্বরনিন্দা, এবং প্রশ্ন তুললেই তার শাস্তি জাহান্নাম। এতে করে খেলাটির নীতিনৈতিক ভিত্তি থাকে না, এবং দাবি হয়ে দাঁড়ায় অলঙ্ঘনীয় একক কর্তৃত্বের অন্ধ প্রতিচ্ছবি।
যেকোনো চ্যালেঞ্জ, বিতর্ক বা দাবি যাচাইয়ের জন্য একটি মৌলিক শর্ত হলো—একজন নিরপেক্ষ ও যোগ্য বিচারকের উপস্থিতি, যিনি উভয় পক্ষের বক্তব্য, প্রমাণ ও যুক্তি বিবেচনায় এনে সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। কোরআনের দাবি যদি হয়—“এ বইয়ের অনুরূপ কিছু কেউ আনতে পারবে না”—তাহলে সেই দাবির বৈধতা নির্ধারণ করতে হলে একজন এমন বিচারকের প্রয়োজন, যার যথেষ্ট সাহস, যুক্তিবোধ এবং নৈতিক দৃঢ়তা আছে, যাতে তিনি স্বয়ং আল্লাহকেও যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারেন। তিনি এমনভাবে বিচার করবেন যেখানে কোরআনপন্থী দাবি ও এর প্রতিপক্ষ—দু’পক্ষই সমান সুযোগে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার পায়, এবং বিচারক নিজে পক্ষপাতহীনভাবে যুক্তি, সাহিত্যমান, মানবিকতা ও যৌক্তিকতার মানদণ্ডে সবকিছু যাচাই করেন।
কিন্তু বাস্তবে এমন কোনো বিচারক থাকতে পারে না। কারণ এই বিচারককে আল্লাহর বাণীকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করাই নয়, তা প্রত্যাখ্যানেরও অধিকার রাখতে হবে যদি তিনি সত্যই নিরপেক্ষ হন। কিন্তু এমন অধিকার রাখা মানেই—তিনি আল্লাহর চাইতেও উচ্চতর এক সত্তা। কারণ, যার কথার উপর বিচার বসানো যায়, তার উপরে অবশ্যই সে বিচারকের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্তৃত্ব থাকতে হয়। অথচ ইসলাম ধর্ম অনুসারে আল্লাহই সর্বোচ্চ, অপ্রশ্ননীয় এবং সর্বজ্ঞ। ফলে কেউ যদি আল্লাহর বাণীর সঠিকতা নির্ধারণের দায়িত্ব নেন, তবে তাকেই হতে হবে সেই দাবিকৃত সর্বোচ্চের চেয়েও উন্নত। এ এক কুযুক্তির ফাঁদ—যেখানে যারা বিচার করতে পারতেন, তারা “অযোগ্য” হয়ে যান ইসলামে বিশ্বাসের কারণে; আর যারা “যোগ্য”, তারা মুসলিমের চোখে হয়ে যান কাফের, অবমাননাকারী এবং মৃত্যুদণ্ডযোগ্য, সর্বপরি ইহুদি নাসারা নাস্তিকদের ষড়যন্ত্র!
এই পরিস্থিতিতে কোরআনের “তুলনা করো” চ্যালেঞ্জটি শেষ পর্যন্ত একটি পক্ষপাতদুষ্ট, একতরফা ও আত্মরক্ষামূলক ঘোষণা ছাড়া কিছুই থাকে না—যেখানে বিচারপতি নেই, বিচারপ্রক্রিয়া নেই, শুধুই এক অলঙ্ঘনীয় কর্তৃত্ববাদী দাবি। এই দাবি যুক্তির ভাষায় বিচার চায় না, বরং বিশ্বাসের চোখে সিজদা দাবি করে।
ধরা যাক, কেউ যদি দাবী করে—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা রবীন্দ্রসংগীতের মত আর কিছু লেখা সম্ভব নয়। পৃথিবীর আর কোনো মানুষ রবীন্দ্রসংগীতের মত নতুন সংগীত রচনা করতে পারবে না। আর এই যুক্তি থেকে যদি কেউ বলে, সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, এমনকি ঈশ্বরস্বরূপ—তাহলে এই দাবিকে আমরা কীভাবে যাচাই করবো?
যদি সত্যিই কেউ রবীন্দ্রসংগীতের ছন্দ, সুর, রাগভিত্তি, অলংকার, অর্থবহ রচনা ও আবেগীয় গঠন অনুসরণ করে একটি নতুন গান লিখে আনে, তখন রবীন্দ্র-ভক্ত বলবেন—"না, এটা আসলে রবীন্দ্রনাথের মত হয়নি।" অথচ যখন কেউ হুবহু রবীন্দ্রনাথের স্টাইল, কাঠামো, বিষয়বস্তু এবং ভাষারীতি অনুসরণ করবে, তখন তারা আবার বলবেন—"তুমি তো নকল করেছো, এটা তো প্ল্যাজারিজম।" অর্থাৎ গানটি একদিকে যদি রবীন্দ্রনাথের মত না হয়- তাহলে বাতিল; আর যদি রবীন্দ্রনাথের মত হয়, তাহলে সেটি চুরি। ফলে এমন একটি দাবিকে কখনই কার্যকরভাবে খণ্ডন করা সম্ভব হয় না, কারণ এর মানদণ্ড এবং বিচারিক কাঠামো শুরু থেকেই পক্ষপাতদুষ্ট ও আত্মরক্ষামূলক।
ঠিক একইরকম কোরআনের এই দাবিটিও—“এর মতো একটি সূরা কেউ রচনা করতে পারবে না।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, কী মানদণ্ডে কেউ বিচার করবে যে এটি ‘মতো’ হলো কি না? ছন্দ, ভাষা, নৈতিকতা, অলৌকিকত্ব—সবই আপেক্ষিক এবং বিচারের জন্য সুসংজ্ঞায়িত কোনো কাঠামো নেই। বিচারকের ভূমিকা পালন করেন যারা কোরআনকে অলৌকিক ধরে নিয়েছেন আগেভাগেই। এই আয়াতটির পরের আয়াতেই (( কোরআন, ২:২৪ )) আল্লাহ নিজেই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করে বসে আছেন। ফলে কেউ যদি মানবিকতা ও যুক্তিনির্ভরতা দিয়ে একটি উৎকৃষ্ট আয়াত রচনা করেন, যেমন: “নিশ্চয় মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই, কেউই ধর্ম বিশ্বাসের কারণে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট হয় না...,” তাহলে মুসলিমরা তা তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করে বলবে—এটি কোরআনের সমতুল নয়। আবার কেউ কোরআনের ছন্দ, গদ্য-কবিতার গঠন বা অলংকার হুবহু অনুকরণ করলেও বলবে—“এটা তো কপি।” এই দ্বিমুখী অবস্থান আসলে দাবিটিকে খণ্ডনের সমস্ত রাস্তা আগেই বন্ধ করে দেয়।
এই পরিস্থিতিতে আমরা যুক্তিবাদীদের পক্ষ থেকে পাল্টা একটি চ্যালেঞ্জ কল্পনা করতে পারি। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম। তাহলে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—আল্লাহ যেন রবীন্দ্রনাথের মতো একটি গান রচনা করে আনেন। আমরা (নাস্তিকরা) সেটি বিচার করবো এবং কোনোভাবেই স্বীকার করবো না যে, সেটি রবীন্দ্রসংগীতের মতো হয়েছে। বরং বলবো, "এটি রবীন্দ্রনাথের মতোই হওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আসলে এই গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গভীরতা নেই, আত্মা নেই, আবেগ নেই, ছায়া মাত্র।" তাহলে এবার কীভাবে মুসলিমরা প্রমাণ করবেন যে, তাদের আল্লাহ সবকিছু পারেন? আমরা তো পুর্বেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি যে, যে যত যাকিছুই নিয়ে আসুক, আমাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারবে না। তাদের নিয়ে আসা সঙ্গীতের সবকিছু অগ্রাহ্য করার সমস্ত নৈতিক ও বিচারিক ক্ষমতা আমাদের হাতে। এখান থেকেই বোঝা যায়, বিচারকের ভূমিকা যদি আগেই পক্ষপাতদুষ্ট হয়, সে যদি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে, কোরআনের মত আয়াত রচনা সম্ভবই নয়, তবে সেই চ্যালেঞ্জের কোনো যুক্তিগত মূল্য নেই। আর এই ধরণের দাবি—যা যাচাই-যোগ্য নয়, খণ্ডনযোগ্য নয়, এবং যেখানে বিচার প্রক্রিয়া কেবল একপাক্ষিক—তা আসলে যুক্তি ও বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে একটি আত্মরক্ষামূলক মতবাদে পরিণত হয়।
সারসংক্ষেপে বলা যায়, "কোরআনের মতো কিছু রচনা করা যাবে না" এই দাবিটি যত না সাহিত্যের, তারচেয়েও বেশি একটি বিশ্বাসনির্ভর কর্তৃত্ব দাবি, যার ভিতরেই লুকিয়ে আছে—আপনি যা কিছুই করে দেখান না কেন, আমাকে মানাতে পারবেন না। বিচার মানি তবে তালগাছটি আমার। এটি যে কোনো বিচারের আগে বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করে নেয়, সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রাখে, যা বিচারের নৈতিকতাকেই নষ্ট করে। এমন বিশ্বাস যদি সত্যের মানদণ্ড হয়ে ওঠে, তাহলে তো কোনো বিশ্বাসই আর ভুল হতে পারে না—চ্যালেঞ্জ করলেই খারিজ, খণ্ডন করলেই প্ল্যাজারিজম কিংবা অনুরূপ হয়নি, এমন সাবজেক্টিভ মতামত।
ধরা যাক, কেউ দাবী করলো:
“অরিজিত সিং-এর মত গান গেয়ে দেখাও।
যদি না পারো, তবে মেনে নাও—অরিজিত সিং-এর গলা স্বয়ং ঈশ্বরের।”
এখানে কুযুক্তি বা যুক্তির ফাঁদটা কী?
অর্থাৎ—
এই অবস্থাকে যুক্তিবিদ্যায় বলা হয় Catch‑22 Fallacy—এখানে তোমার জয় সম্ভব নয়, কারণ যে কোনো ফলাফলকেই পরাজয় হিসেবে ঘোষণা করা হবে। প্রতিযোগিতার নিয়ম এমনভাবে তৈরি যে, তুমি কখনোই সফল হতে পারবে না।
কোরআনের মতো সূরা রচনার চ্যালেঞ্জও একই রকম:
ফলে, পুরো প্রতিযোগিতাটি আসলে একটি প্রি-ডিফাইন্ড ফেইলিওর (Pre-Defined Failure)—অর্থাৎ আগে থেকেই নিশ্চিত করা হয়েছে যে, অন্য কেউ সফল হতে পারবে না। ফলে এটি কোনো প্রকৃত পরীক্ষাই নয়; বরং একটি কুযুক্তি বা যুক্তির ফাঁদ।
তর্কের খাতিরে ধরে নিই, কোরআনের অনুরূপ বলতে কী বোঝানো হয়েছে তার একটি মানদণ্ড নির্ধারিত হলো, এবং সেই মানদণ্ডের চাইতে অনেক ভাল একটি সূরা কেউ লিখতে পারলো। কিন্তু সেই সময়েও বিপদ থাকবে। তখন মুসলিমদের পক্ষ থেকে বলা হবে, তোমাকে এত ভাল আয়াত বা সূরা লেখার ক্ষমতা তো আল্লাহই দিয়েছে। আল্লাহই আসলে তোমার মনের গভীরে ঢুকে এই সুন্দর আয়াতটি শিখিয়ে দিয়েছে। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া তুমি কখনোই তা লিখতে পারতে না। সুতরাং প্রমাণ হলো, আল্লাহ আছে, তাই না? অর্থাৎ আপনি হারলে তো হারবেনই, জিতলেও হারবেন।
কোরআনের এই দাবীর সকল মানদণ্ডই সম্পূর্ণরূপে আপেক্ষিক (subjective) এবং বিচারকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেমন, একজন ইসলামবিশ্বাসীর কাছে কোরআনের একটি আয়াত "ঈশ্বরপ্রদত্ত", অপরদিকে একজন মানবিক, যুক্তিনিষ্ঠ ব্যক্তি সেই একই আয়াতকে অনৈতিক ও ঘৃণামূলক মনে করতে পারেন। তার কাছে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী বর্বর আয়াত মনে হতে পারে।
উদাহরণ: সূরা আল-বাইয়্যিনাহ ৯৮:৬
“নিশ্চয়ই যারা কুফরী করেছে আহলে কিতাব ও মুশরিকদের মধ্য থেকে, তারা জাহান্নামে যাবে এবং সেখানে চিরকাল থাকবে। এরা হলো সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্টতম।”
এই আয়াতে বলা হচ্ছে, শুধুমাত্র বিশ্বাসে ভিন্নতার কারণে (অবিশ্বাসী হওয়া বা "কুফর করা") একদল মানুষ "সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট" এবং তারা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে। এই বক্তব্য:
এখন এই আয়াতটির বিপরীতে, একজন যুক্তিবাদী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ যদি নিম্নলিখিত আয়াতটি রচনা করে:
“নিশ্চয় মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই, কেউই ধর্ম বিশ্বাসের কারণে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট হয় না। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের বৈষম্য করো না। সকল মানুষের মর্যাদা সমান। পৃথিবীর সকল প্রাণীর সুখ ও শান্তি কামনা করো। নিশ্চয়ই মানুষ অন্যান্য প্রাণীর মতোই একটি প্রাণী, তাই অন্য প্রাণীদেরও নিজেদের আত্মার আত্মীয় ভেবে ভালবাসা দাও। নিশ্চয়ই যারা ভালবাসতে পারে তারাই উৎকৃষ্ট, আর যারা ভালবাসে না, কেবল ঘৃণা করে, তারাই নিকৃষ্ট জীব।”
এই আয়াতটি:
এখন প্রশ্ন হলো: কোন আয়াতটি উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হবে না? অন্তত মানবিকতার ক্রাইটেরিয়াতে?
একজন মুসলিম বলবে: "নাহ, কোরআনের আয়াতই উৎকৃষ্ট", কারণ তারা মনে করেন কোরআনের ভাষা অলৌকিক, এর শব্দচয়ন অনন্য, এবং এটি আল্লাহর বাণী। একইসাথে উনারা বলতে পারেন, কোরআনের ভাষা তো আরবি। অন্যদিকে, একজন মানবিক ও যুক্তিবাদী ব্যক্তি বলবে: "এই মানবিক আয়াতটিই উৎকৃষ্ট, কারণ এতে রয়েছে ভালোবাসা, সমতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সকল জীবের প্রতি সহানুভূতি। ভাষা বা ছন্দের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বক্তব্যটি কী তা।"
অর্থাৎ, “কোনটি উৎকৃষ্ট” তা নির্ভর করছে বিচারকের মানসিক কাঠামো, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাসের উপর — যা সংজ্ঞানুসারে সাবজেকটিভ ফ্যাক্টর। এই কারণেই কোরআনের এই চ্যালেঞ্জ সাবজেকটিভ ক্রাইটেরিয়ার ফ্যালাসিতে পড়ে।
এই ফ্যালাসির প্রকৃতি
একটি মানদণ্ড যদি বৈজ্ঞানিক, নিরপেক্ষ এবং যাচাইযোগ্য না হয় — যেমন সৌন্দর্য, ছন্দ, ভাষার জাঁকজমক — তবে সেই মানদণ্ডে ভিত্তি করে “এই রকম কিছু কেউ করতে পারবে না” বলা যুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থহীন।
উদাহরণ:
এখানে নৈতিক উৎকর্ষের দাবী বা ভাষার সৌন্দর্য পরিমাপযোগ্য নয়, কারণ এর মানদণ্ড প্রতিটি ব্যক্তির বিশ্বাস ও সংস্কার দ্বারা গঠিত
তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যাক যে, কোরআনের এমনই অসাধারণ রচনাশৈলী যে, কেউই এর মত কিছু লিখতে পারবে না! কোরআনের চ্যালেঞ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ যৌক্তিক ত্রুটি হলো ভুল দ্বৈত বিভাজন (False Dichotomy) বা মিথ্যা দ্বিধা ফ্যালাসি (False Dilemma Fallacy)। এই ফ্যালাসিতে এমনভাবে দুটি বিকল্প উপস্থাপন করা হয় যেন মনে হয় সেগুলোই একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান, যদিও বাস্তবে আরও অনেক বিকল্প বিদ্যমান থাকে। চ্যালেঞ্জটি একটি সরলীকরণকৃত যুক্তি দেয়:
এই যুক্তিটি অন্যান্য বহু সম্ভাব্য ব্যাখ্যা বা বিকল্পকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেয়, যা এই ফ্যালাসির মূল বৈশিষ্ট্য। কোরআনের মতো একটি প্রভাবশালী এবং অনন্য সাহিত্যকর্মের উৎস হিসেবে কেবল "আল্লাহর বাণী" অথবা "অন্য কারও দ্বারা কপিযোগ্য" এই দুটি বিকল্পই একমাত্র সত্য নয়। আরও যুক্তিসঙ্গত সম্ভাবনা থাকতে পারে, যেমন:
এইসব যৌক্তিক এবং বাস্তবসম্মত বিকল্পগুলোকে বাদ দিয়ে কেবল "আল্লাহর বাণী" অথবা "মানুষের নকল-অযোগ্য" এই দুটি অপশনেই সীমাবদ্ধ থাকাটি একটি ভুল দ্বৈত বিভাজন, যা যুক্তির দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ। এটি প্রমাণের একটি সংকীর্ণ পথ তৈরি করে, যেখানে মূল দাবির পক্ষে অন্য কোনো ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করা হয় না।
এই চ্যালেঞ্জ নিজেকেই প্রমাণ করে:
“কোরআন আল্লাহর বাণী কারণ কেউ এর মতো লিখতে পারে না, আর কেউ লিখতে পারে না কারণ এটা আল্লাহর বাণী।”
এটি যুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে একটি স্পষ্ট বৃত্তাকার যুক্তি (( চক্রাকার কুযুক্তি | Circular logic ))।
যুক্তির জগতে একটি মৌলিক নীতিই হলো—যিনি কোনো দাবি উত্থাপন করবেন, প্রমাণের দায়িত্বও তাঁরই। অর্থাৎ কেউ যদি বলেন, “এই গ্রন্থটি আল্লাহর বাণী,” তাহলে প্রমাণ করার দায়িত্বও সম্পূর্ণভাবে তাঁর কাঁধেই বর্তায়। এই প্রমাণ হতে হবে পর্যবেক্ষণ, যুক্তি, নৈতিকতা, ভাষাগত উৎকর্ষ এবং মানবিকতার ভিত্তিতে—যেমনটি যেকোনো সত্য দাবির ক্ষেত্রেই হওয়া উচিত। কিন্তু ইসলামি যুক্তির ক্ষেত্রে চিত্রটি সম্পূর্ণ উল্টো। এখানে দাবিদার নিজে কিছু প্রমাণ না করেই সরাসরি অপরপক্ষকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বসেন—“এর মতো কিছু লিখে দেখাও।” অথচ কোরআনের ঐশী উৎস কিংবা অলৌকিকতার দাবির পক্ষে আগে প্রমাণ থাকা জরুরি, নতুবা তা নিছক দাবি মাত্র।
এই চ্যালেঞ্জমূলক অবস্থান আসলে একটি সুপরিচিত যুক্তিগত বিভ্রান্তি—Shifting the Burden of Proof, (( অপ্রমাণের বোঝা কুযুক্তি | Burden of proof )) অর্থাৎ প্রমাণের দায়কে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে প্রতিপক্ষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। এটি যুক্তির এক ধূর্ত ফাঁদ, যেখানে নিজে কোনো নিরপেক্ষ বা যাচাইযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন না করেই, শুধু অপরপক্ষের ব্যর্থতাকে নিজের দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়। যেমন কেউ যদি বলে, “তুমি যদি প্রমাণ করতে না পারো যে এটা আল্লাহর বাণী নয়, তাহলে ধরে নিতে হবে এটি আল্লাহর বাণী”—এটি যুক্তির চোখে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ও ভিত্তিহীন। প্রমাণহীন দাবিকে চ্যালেঞ্জে রূপান্তর করে যুক্তি জিতে যাওয়ার এই কৌশল এক ধরনের প্রতারণা, যা যুক্তিনিষ্ঠ বিতর্কে কখনোই স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়।
কোরআনের অলৌকিকতার সপক্ষে প্রায়শই একটি যুক্তি উপস্থাপন করা হয় যে, "ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবের কোনো কবি বা সাহিত্যিক এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে পারেনি।" এটি এক প্রকার পক্ষপাতদুষ্ট কর্তৃত্বের প্রতি আবেদন (Appeal to Biased Authority) নামক যৌক্তিক ত্রুটি। এই ফ্যালাসিতে এমন ব্যক্তির বক্তব্যকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যার নিজস্ব স্বার্থ বা পূর্বনির্ধারিত বিশ্বাস থাকে, যা তার মতামতকে প্রভাবিত করতে পারে।
৭ম শতাব্দীর আরবে কবিতা ছিল সমাজের প্রাণকেন্দ্র। সেই সময়ের কবিরা ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং তাদের কাব্যিক দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। যখন ইসলাম আবির্ভূত হয় এবং কোরআনের চ্যালেঞ্জ প্রচারিত হয়, তখন সেই কবিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের কথিত "ব্যর্থতা" কেন পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে, তা কয়েকটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়:
১. ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আনুগত্য: অনেক কবি, যারা হয়তো প্রাথমিকভাবে ইসলামের সমালোচক ছিলেন, পরবর্তীতে মুসলিম হয়ে যান। একবার ইসলাম গ্রহণ করার পর, তাদের পক্ষে কোরআনের ঐশ্বরিক প্রকৃতি বা সাহিত্যিক শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা সম্ভব ছিল না। তাদের পূর্বের যেকোনো "চেষ্টা" বা "বিরুদ্ধতা" তখন তাদের নতুন বিশ্বাসের কারণে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। একজন ধর্মান্তরিত ব্যক্তির পক্ষে নিজেদের নতুন ধর্মগ্রন্থের সমালোচনা করা কেবল অবিশ্বস্ততার পরিচায়কই ছিল না, বরং তাদের নিজেদের বিশ্বাসকেই অস্বীকার করার শামিল হতো। আর ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কায় কোন কবি যদি কোরআনের অনুরূপ সূরা লিখেও থাকে, পরবর্তীতে মক্কা বিজয় করার পরে মুহাম্মদের অনুসারীগণ নিশ্চয়ই সেগুলো আর অক্ষত রাখেননি, তাই না?
২. সামাজিক চাপ এবং নিরাপত্তা: তৎকালীন আরব সমাজে ইসলাম একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি হিসেবে দ্রুত প্রসার লাভ করছিল। যারা ইসলামের বিরোধিতা করত বা এমনকি বিশ্বাস করতো না, তাদের প্রায়শই সামাজিক বর্জন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, এবং এমনকি আক্রমণাত্মক জিহাদ বা শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো। মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে কাব্য রচনা করাকে বিদ্রোহ বা অবমাননা হিসেবে দেখা হতো, যার পরিণতি ছিল অত্যন্ত গুরুতর। উদাহরণস্বরূপ, যেসব কবি বা ব্যক্তি ইসলামের সমালোচনা করেছিলেন, তাদের অনেককে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল (যেমন কাব ইবনে আশরাফ)। এই ধরনের ভয়াবহ সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপের মুখে দাঁড়িয়ে একজন কবির পক্ষে মুক্ত মনে কোরআনের "চ্যালেঞ্জ" গ্রহণ করা এবং এর বিরুদ্ধে সফল কিছু রচনা করা কার্যত অসম্ভব ছিল। তাদের নীরবতা বা অস্বীকৃতিকে "ব্যর্থতা" হিসেবে গণ্য করা যায় না, বরং এটি ছিল টিকে থাকার এক কৌশল।
৩. "ঐতিহাসিক বিজয়ীর" দৃষ্টিকোণ: ইসলামের দ্রুত বিস্তার এবং রাজনৈতিক বিজয়ের পর, ইতিহাস বিজয়ী পক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে। যেসব কবি হয়তো চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সফল হননি (এবং এর কোনো রেকর্ড নেই), অথবা যাদের কাজকে ইচ্ছাকৃতভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, তাদের কথা ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিজয়ী পক্ষ সব সময় তাদের নিজেদের বয়ানকে শক্তিশালী করে তোলে এবং বিরোধীদের অবদানকে খাটো করে দেখায়।
অতএব, যখন বলা হয় যে "তৎকালীন কবিরা এটি অতিক্রম করতে পারেনি," তখন এটি একটি পক্ষপাতদুষ্ট কুযুক্তি হয়ে দাঁড়ায়। তাদের এই কথিত "ব্যর্থতা" নিরপেক্ষ সাহিত্যিক বিচার নয়, বরং ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক-রাজনৈতিক চাপের ফলশ্রুতি ছিল। তাদের মতামত বা নীরবতাকে কোরআনের অপ্রতিরোধ্য সাহিত্যিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না, কারণ তাদের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার স্বাধীনতা ছিল সীমিত বা অস্তিত্বহীন।
কোরআনের এই দাবিটি একটি গুরুতর যৌক্তিক ত্রুটিতে জর্জরিত, যা অবিচার্যতা বা Non-Falsifiability নামে পরিচিত। কার্ল পপারের (Karl Popper) ফ্যালসিফাইয়াবিলিটি প্রিন্সিপল (Falsifiability Principle) অনুযায়ী, একটি বৈজ্ঞানিক বা অর্থপূর্ণ দাবিকে অবশ্যই এমনভাবে প্রণীত হতে হবে যেন তাকে মিথ্যা প্রমাণ করার একটি পদ্ধতি থাকে। যদি কোনো দাবিকে কোনো সম্ভাব্য প্রমাণ দ্বারা মিথ্যা প্রমাণ করা না যায়, তবে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সেই দাবিটি অর্থহীন।
কোরআনের "অনুরূপ কিছু রচনা করার চ্যালেঞ্জ" এই অবিচার্যতার ফাঁদে পড়ে যায়, কারণ এর ফলাফলকে যেকোনো মূল্যে প্রত্যাখ্যান করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে:
এভাবে, চ্যালেঞ্জের ফলাফল যাই হোক না কেন, দাবিকারী পক্ষ সেটিকে নিজেদের দাবির সপক্ষে ব্যবহারের একটি পথ খুঁজে পায়। চ্যালেঞ্জকারী কখনোই প্রমাণ করতে পারে না যে চ্যালেঞ্জটি ভুল, কারণ তার প্রতিটি প্রচেষ্টাই কোনো না কোনো অজুহাতে বাতিল হয়ে যায়। এই দ্বিমুখী অবস্থানের কারণে দাবিটি Falsifiable নয়, যা এটিকে বিজ্ঞানের ভাষায় একটি অর্থহীন বা অপরীক্ষণযোগ্য দাবিতে পরিণত করে।
এটি একটি সুপরিচিত লজিক্যাল ফ্যালাসি, যার প্রচলিত নামগুলো হলো "নো-উইন সিচুয়েশন" (No-Win Situation) বা "ক্যাচ-২২" (Catch-22)। এটি সেই ধরনের অবস্থা যেখানে প্রতিপক্ষের জেতার কোনো উপায়ই থাকে না, কারণ ফলাফলের যেকোনো দিকই মূল দাবির সপক্ষে চলে যায়। এই ফ্যালাসিটিকে আরও স্পষ্ট করে বোঝাতে "হেডস আই উইন, টেইলস ইউ লুজ ফ্যালাসি" (Heads I Win, Tails You Lose Fallacy) নামেও অভিহিত করা হয়, যা নির্দেশ করে যে দাবিকারী এমনভাবে নিয়ম সেট করে যেন ফলাফল সবসময় তার পক্ষেই যায়, ফলাফল যাই হোক না কেন। এই "প্ল্যাগিয়ারিজম ফাঁদ" তৈরি হয় যখন একটি চ্যালেঞ্জ বা দাবির জন্য এমন মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয় যা ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট, পরস্পরবিরোধী, বা অসম্ভব হয়ে থাকে, যাতে চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী কখনোই সফল হতে না পারে।
কোরআনের চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে এই ফ্যালাসিটি এভাবে কাজ করে: যদি কেউ কোরআনের ভাষা, কাঠামো, ছন্দ বা স্টাইল হুবহু বা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে অনুকরণ করে একটি সূরা রচনা করে, তাহলে দাবিকারী পক্ষ বলে, "এটা তো নকল বা অনুকরণ।" অর্থাৎ, "অনুরূপ" বলতে হুবহু নকল করা হলেও তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়। আবার, যদি কেউ নিজস্ব সৃজনশীলতা দিয়ে ভিন্ন স্টাইলে একটি উচ্চমানের সাহিত্যকর্ম তৈরি করে (যা গুণগতভাবে তুলনীয়), তখন দাবিকারী পক্ষ বলে, "এটা তো কোরআনের মতো নয়।" অর্থাৎ, গুণগত মান বা প্রভাবের দিক থেকে অনুরূপ হলেও, কেবল স্টাইলের ভিন্নতার অজুহাতে তা বাতিল করা হয়। এই দ্বিমুখী অবস্থান প্রমাণ করে যে মূল দাবিটি অযৌক্তিক ও অসঙ্গত বিচার ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে চ্যালেঞ্জকারীর সাফল্যের কোনো পথ খোলা রাখা হয় না, ফলে মূল দাবিটি কখনোই মিথ্যা প্রমাণিত হয় না।
কোরআনের এই "চ্যালেঞ্জ" বোঝার জন্য ৭ম শতাব্দীর আরবের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি। সেই সময়ে আরব সমাজে কবিতা ছিল জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং সামাজিক প্রতিপত্তির প্রধান মাপকাঠি। কাব্যের মাধ্যমে গোত্রের বীরত্ব, পূর্বপুরুষদের মহিমা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি তুলে ধরা হতো। বাগ্মিতা ও কাব্যিক দক্ষতা ছিল আরবী ভাষার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা মানুষের মন জয় করতে বা তাদের প্ররোচিত করতে সক্ষম ছিল। সে যুগে একজন কবি বা সাহিত্যিককে সমাজের সর্বোচ্চ আসনে বসানো হতো। নিয়মিত কাব্যিক প্রতিযোগিতা (যেমন উকাজের মেলায়) অনুষ্ঠিত হতো, যেখানে কবিরা তাদের নতুন সৃষ্টি নিয়ে আসতেন এবং বিচারকদের সামনে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতেন।
এই প্রেক্ষাপটে, যখন কোরআন দাবি করল যে এর মতো একটি সূরা কেউ রচনা করতে পারবে না, তখন এটি কেবল একটি সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জ ছিল না, বরং এটি ছিল তৎকালীন আরব সমাজের প্রচলিত কাব্যিক প্রতিযোগিতার ধারায় একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এটি হয়তো সেই যুগের মানুষের কাছে কোরআনের অলৌকিকতা বা ঐশ্বরিক উৎসের একটি প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
তবে, সমস্যাটি হলো, সেই ৭ম শতাব্দীর কাব্যিক প্রেক্ষাপটে যা একটি প্রাসঙ্গিক এবং শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ ছিল, তাকে আজকের বৈশ্বিক সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং যুক্তির যুগে দাঁড় করানো একটি সুস্পষ্ট "Context Fallacy" বা "ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অস্বীকারের ত্রুটি"। আধুনিক যুগে সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং যুক্তির মানদণ্ড অনেক বিস্তৃত এবং বহু-মাত্রিক। আজকের দিনে কোনো গ্রন্থের শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তার কাব্যিক সৌন্দর্যের উপর নির্ভর করে না, বরং তার দার্শনিক গভীরতা, বৈজ্ঞানিক সঙ্গতি, নৈতিক মূল্যবোধ এবং সামগ্রিক প্রভাবের উপরও নির্ভর করে। সুতরাং, ৭ম শতাব্দীর একটি সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জকে বর্তমানের বিস্তৃত জ্ঞান ও যুক্তির পরিমাপে বিচার করা হলে তা তার মূল প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং অযৌক্তিক মনে হয়।
“কোরআনের মতো কিছু রচনা করা যাবে না” — কোরআনের এই দাবিটি, যা তার ঐশ্বরিক উৎসের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়, যুক্তিবাদী বিশ্লেষণে একাধিক গুরুতর যৌক্তিক ত্রুটিতে জর্জরিত। এই প্রবন্ধে আমরা যেমন দেখেছি, এটি কেবল একটি সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জ নয়, বরং সাবজেক্টিভ মানদণ্ডের ত্রুটি, মিথ্যা বিকল্পের ভ্রান্তি, বৃত্তাকার কুযুক্তি, প্রমাণের ভার প্রতিপক্ষের ওপর চাপানো, পক্ষপাতদুষ্ট কর্তৃত্বের প্রতি আবেদন এবং অবিচার্যতা (Non-Falsifiability)-এর মতো বিভিন্ন ফ্যালাসিতে আচ্ছন্ন। এই ত্রুটিগুলি সম্মিলিতভাবে চ্যালেঞ্জটিকে একটি "প্ল্যাগিয়ারিজম ফাঁদ" বা "নো-উইন সিচুয়েশন"-এ পরিণত করে, যেখানে চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারীর সফল হওয়ার কোনো পথই খোলা থাকে না।
এছাড়াও, ৭ম শতাব্দীর আরবের প্রেক্ষাপটে হয়তো এর এক ধরনের প্রাসঙ্গিকতা ছিল, কিন্তু আজকের বৈশ্বিক সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক ও যুক্তির মানদণ্ডে এটি একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অস্বীকারের ত্রুটি (Context Fallacy)। উপরন্তু, এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারীদের জন্য যে বাস্তব জীবনের হুমকি ও পরিণতি বিদ্যমান, তা প্রমাণ করে যে এটি কোনো মুক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাহিত্যিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং এটি একটি বিশ্বাস-ভিত্তিক আত্মরক্ষামূলক দাবি যা যুক্তি, প্রমাণ বা উন্মুক্ত আলোচনার জন্য কোনো স্থান রাখে না। সত্য ও যুক্তি কেবল সাহিত্যিক সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা বা অলৌকিকতার দাবি নয়, বরং প্রমাণ, বিশ্লেষণ এবং ন্যায়বিচারের অন্বেষণ।