03.যুক্তির মাইক্রোস্কোপে প্যাসকেলের বাজি (Pascal’s Wager)
user
September 28, 2024
687 views
দার্শনিক সমস্যাবলী

ভূমিকা

প্যাসকেলের বাজি (Pascal’s Wager) হলো ফরাসি দার্শনিক ও গণিতবিদ ব্লেইজ প্যাসকেল (Blaise Pascal) কর্তৃক উত্থাপিত একটি ধর্মীয় ও দার্শনিক যুক্তি, যা প্রথমবারের মতো ১৬৭০ সালে তার বিখ্যাত গ্রন্থ Pensées এ প্রকাশিত হয়। প্যাসকেল মূলত খ্রিস্টীয় বিশ্বাস ও ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি প্রদান করতে গিয়ে এই "বাজি" ধারণা উপস্থাপন করেন। এই ধারণাটি প্রাথমিকভাবে দর্শন ও ধর্মীয় দুনিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি প্রদানকারী একটি যুগান্তকারী চিন্তাধারার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই যুক্তিটি ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয় এবং এতে থাকা অসামঞ্জস্যতা ও যৌক্তিক ত্রুটি নিয়ে দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন তোলেন।

প্যাসকেলের বাজির মূল ধারণাটি হলো, ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করার মাধ্যমে একজন মানুষ সবসময় লাভবান হতে পারেন, কারণ ঈশ্বর যদি থাকেন, তাহলে সে পরকালে অসীম পুরস্কার লাভ করবে। অন্যদিকে, যদি কেউ ঈশ্বরে অবিশ্বাস করে এবং ঈশ্বর থাকেন, তাহলে তাকে অসীম শাস্তি ভোগ করতে হবে। এভাবে, একজন বুদ্ধিমান ও বাস্তববাদী ব্যক্তি হিসেবে মানুষকে ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করতে উৎসাহিত করা হয়েছে, কারণ এটি "বাজির" দৃষ্টিকোণ থেকে অধিক লাভজনক।

এই যুক্তি প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর, খ্রিস্টীয় সমাজে এটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয় এবং ধর্মীয় প্রচারের জন্য একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ধর্মীয় নেতারা একে বিশ্বাস স্থাপনের পক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন। তবে, দর্শন ও বিজ্ঞান জগতের অনেক পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ এই যুক্তির অভ্যন্তরীণ ত্রুটি, অসঙ্গতি এবং দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করেন। তাদের মতে, প্যাসকেলের বাজি মূলত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ধাপ্পাবাজি, যেখানে বিশ্বাসকে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা বা প্রমাণের ভিত্তিতে নয়, বরং লাভ ও ক্ষতির ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। এর ফলে, বিশ্বাসের প্রকৃত ধারণা ও আত্মিক মূল্যবোধকে অবমূল্যায়ন করা হয়।

পরবর্তীকালে এই যুক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা, এমনকি ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যেও একটি বিরাট অংশ এর কঠোর সমালোচনা করেন এবং একে একটি অপ্রমাণিত, অযৌক্তিক এবং ত্রুটিপূর্ণ চিন্তাধারা হিসেবে অভিহিত করেন। তারা দাবি করেন যে, বিশ্বাস হলো ব্যক্তির চিন্তা, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতার ফলাফল, যা কোনো ধরনের লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে স্থির করা উচিত নয়। সুতরাং, প্যাসকেলের বাজি নিয়ে দার্শনিক বিতর্ক ও আলোচনার যে অধ্যায় শুরু হয়, তা আজও দর্শনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হিসেবে পরিগণিত।


বহুধর্মীয়তার সমস্যা (Problem of Many Gods)

প্যাসকেলের বাজির অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো এটি শুধুমাত্র একটি ঈশ্বরের অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করে, এবং তার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে আসে। এই যুক্তি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বা ঈশ্বরের ধারণাকেই প্রাধান্য দেয়। প্যাসকেলের যুক্তিটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন, শুধুমাত্র খ্রিস্টীয় ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা বা তার পুরস্কার-শাস্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীতে বহু ধর্ম এবং তাদের প্রতিটিরই আলাদা আলাদা ঈশ্বরের ধারণা, পরকাল, এবং নৈতিকতার সংজ্ঞা রয়েছে। প্যাসকেলের বাজিকে যদি সঠিক ধরে নিই, তাহলে পৃথিবীতে ৪২০০ টি ধর্ম, প্রতিটিরই সত্য হওয়ার সম্ভাবনা সমান। যেহেতু কোন ধর্মের সপক্ষেই তেমন কোন প্রমাণ নেই। অর্থাৎ, প্রতীতি ধর্মের আলাদা আলাদা ঈশ্বরেরই সত্য হওয়ার সম্ভাবনাকে আমলে নিতে হবে। তাই, প্যাসকেলের বাজি সব ধর্মমতকে আমলে নিলে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং এটি একটি বড় সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।

ধরা যাক, প্যাসকেলের যুক্তি অনুযায়ী কেউ খ্রিস্টীয় ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন এবং এটি ধরে নেন যে, খ্রিস্টীয় ঈশ্বরই একমাত্র সঠিক। যদি পরকালে দেখা যায় যে খ্রিস্টীয় ঈশ্বরের বদলে ইসলামের ঈশ্বর বা প্রাচীন গ্রিসের জিউস বা হিন্দুদের দেবতা শিব বা অন্য কোনো ধর্মের দেবতা প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্বশীল, তাহলে সেই ব্যক্তি পরকালে পুরস্কার তো পাবেনই না, বরং শাস্তির সম্মুখীন হতে পারেন। অর্থাৎ, ভুল ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করা মূলত কোনো লাভের চেয়ে ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ পরকালে শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কেবলমাত্র একজন অবিশ্বাসীর জন্য নয়, বরং ভুল পরিবারে জন্ম নিয়ে ভুল ঈশ্বর বা ভুল ধর্মকে বিশ্বাস করা ব্যক্তিদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য।

এই পরিস্থিতি আরো জটিল হয় যখন বিভিন্ন ধর্মের পরকালীন ধারণাগুলো পরস্পরের বিপরীতমুখী হয়। যেমন, খ্রিস্টীয় ধর্মে যীশুর (Jesus Christ) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ বলা হয়েছে, আবার ইসলাম ধর্মে ঈশ্বরের একত্ব (তাওহিদ) এবং মুহাম্মদ (সা.)-কে শেষ নবী হিসেবে বিশ্বাস করাকে ঈমানের অন্যতম শর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অন্যদিকে, হিন্দু ধর্মে আবার পুনর্জন্মের ধারণা ও কর্মফলকে (karma) গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই, প্যাসকেলের বাজির ভিত্তিতে কোনো একটি ধর্মকে বেছে নেওয়া খুবই সমস্যাসংকুল, কারণ প্রতিটি ধর্মের নিজস্ব ঈশ্বর, বিশ্বাস ব্যবস্থা, এবং শাস্তি-পুনর্বাসনের ধারণা আলাদা। আপনার যদি শতভাগ নিশ্চয়তা পেতে হয়, এবং আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি যদি যুক্তি তথ্য প্রমাণ না হয়ে বাজি ধরা হয়, তাহলে একইসাথে আপনার সবগুলো ঈশ্বরকেই বিশ্বাস করতে হবে। যুক্তি বাদ দিয়ে অন্ধবিশ্বাস এবং বাজি ধরা যদি এই পদ্ধতির ভিত্তি হয়, তাহলে সবগুলো ঈশ্বরকেই আপনার পূজা করতে হবে এই কারণে যে, এর মধ্যে যেকোনোটিই তো সত্য হতে পারে। সেখানেও রয়েছে আরেকটি বিরাট সমস্যা। অধিকাংশ ঈশ্বর আসলে জেলাস গড, অর্থাৎ তারা হিংসুটে বা ঈর্ষা পরায়ণ। তারা অন্য ঈশ্বরকেও একইসাথে বিশ্বাস করাকে সর্বোচ্চ অপরাধ মনে করে। যেমন ইসলামে শিরকের ধারণা। অর্থাৎ এক ঈশ্বরের পূজা অন্য ঈশ্বর কিছুতেই মেনে নিবে না, চরম শাস্তি দিবে। তাহলে এর মধ্যে কোনটি মানবো? আবার, হাদিসে বর্ণিত আছে যে, ইসলাম ধর্মের নবী বলেছেন, তার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ ফির্কায়; এদের মধ্যে ৭২টি ফির্কাহ হবে জাহান্নামী আর একটি মাত্র জান্নাতী (( হাদীস সম্ভার, হাদিসঃ ১৫২৮ ))। তার অর্থ হচ্ছে, ইসলামের আল্লাহকে বিশ্বাস করলেও, আপনি কোন ফির্কার পরিবারে জন্মেছেন, কোন ফির্কাকে বিশ্বাস করছেন, তারাই জান্নাতে যাবে কিনা, তার কোন ঠিক নেই। এতে আপনার সম্ভাবনা আরও কমে যাচ্ছে।

এই সমস্যাকে বলা হয় "বহু ঈশ্বরের সমস্যা" (Problem of Many Gods)। প্যাসকেলের যুক্তিতে বলা হয়েছে, আপনি যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং ঈশ্বর থাকেন, তাহলে আপনি পুরস্কৃত হবেন। কিন্তু যদি একইভাবে পৃথিবীতে শত শত ধর্ম এবং প্রতিটির আলাদা আলাদা ঈশ্বরের ধারণা থাকে, তাহলে আপনি কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস করবেন? যদি আপনি একটি ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং পরকালে দেখা যায়, অন্য কোনো ঈশ্বর সত্য, তাহলে আপনি শাস্তি পেতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে আপনার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা (Probability) খুবই কম, কারণ আপনার সামনে একাধিক বিকল্প রয়েছে এবং প্রতিটি বিকল্পের সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা সমান। এই সমস্যাটিকে "বহু ঈশ্বরের সমস্যা" বলা হয়, যা প্যাসকেলের যুক্তিকে যৌক্তিকভাবে দুর্বল এবং অসংলগ্ন করে তোলে।


উদাহরণ: ৪২০০ ভুয়া কোম্পানি এবং বাড়ির প্রতিশ্রুতি

ধরুন আপনি একটি অফার পান—উল্টাপাল্টা২৪ নামক একটি কোম্পানির বলছে,

“আমাদেরকে প্রতি মাসে মাত্র ১০০০ টাকা করে দিলেই ১০ বছর পরে আমরা আপনাকে একটি বিলাসবহুল ১০০ তলা বাড়ি উপহার দেব।”

এরপরে দেখা গেল, আরও অনেকগুলো কোম্পানিও একই অফার দিচ্ছে। প্রত্যেকেই বলছে, তাদের প্রতিমাসে টাকা দিলে তারা ১০ বছর পরে একটি বিলাসবহুল বাড়ি দিবে। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি কোম্পানিই অন্য কোম্পানিগুলোকে ভুয়া বলছে। এই কোম্পানিগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো:

বিষয়অবস্থা
কোম্পানির নাম৪২০০টি আলাদা নাম (মনে করুন "হক হাউজিং", "স্বর্গ রিয়েল এস্টেট", "সত্য বাড়ি লিমিটেড", ইত্যাদি)
মালিক কে?কেউ জানে না তিনি কোথায়, কেউ কোনদিন দেখেনি
সরকারি রেজিস্ট্রেশননেই
পূর্বে কাউকে বাড়ি দিয়েছে কি?না, এমন কোনো প্রমাণ নেই
টাকা দিতে হয় কাদের?অজানা প্রতিনিধি, যারা বলে "বিশ্বাস করো"
বাড়িটির অবস্থান কোথায়?অবস্থান অজ্ঞাত, শুধু প্রতিশ্রুতি
প্রমাণ?শুধু ‘বিশ্বাস’ ও প্রচার

এখন প্রশ্ন: এই ৪২০০টি কোম্পানির মধ্যে কোন একটি আসলেই বাড়ি দিয়ে দিতে পারে—এই আশায় আপনি কি তাদের যেকোনো একটি কোম্পানিকে টাকা দেওয়া শুরু করবেন? যদি বলেন, "হ্যাঁ", তবে প্রশ্ন: কেন এই একটি, বাকি ৪১৯৯টি নয়?

এর মানে দাঁড়ায়:

  • আপনি বিশ্বাস করছেন এমন একটি কোম্পানিকে যে কোম্পানির কাছে কোনও প্রমাণ নেই।
  • একই রকম দাবি আরও ৪১৯৯টি কোম্পানিও করছে।
  • তারা পরস্পরবিরোধী কথা বলে: একে অপরকে ভুয়া বলে।

এখন চলুন, প্যাসকেলের ওয়েজারের সঙ্গে এই উদাহরণটি মিলিয়ে দেখি।


টেবিল: প্যাসকেলের ওয়েজার বনাম ৪২০০ কোম্পানি উদাহরণ

বিষয়প্যাসকেলের ওয়েজার৪২০০ কোম্পানির উদাহরণ
বিশ্বাস করলে লাভস্বর্গবিলাসবহুল বাড়ি
অবিশ্বাস করলে ক্ষতিনরকবাড়ি পাবেন না, তবে আপনার উপার্জিত অর্থ আপনার কাছেই থাকবে
বিশ্বাসযোগ্যতাকোনও পরীক্ষাযোগ্য প্রমাণ নেইকোনও পরীক্ষাযোগ্য প্রমাণ নেই
বিকল্পের সংখ্যা৪২০০+ ধর্ম৪২০০ কোম্পানি
একে অপরকে ভুল বলেহ্যাঁ (এক ধর্ম বলে অন্য ধর্ম মিথ্যা)হ্যাঁ (সব কোম্পানি বলে, "শুধু আমরা আসল")
লাভের নিশ্চয়তা‘অন্ধবিশ্বাস আর অন্ধআনুগত্যে’‘অন্ধবিশ্বাস আর অন্ধআনুগত্যে’
মালিকের পরিচয়অজানা ঈশ্বর যার অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নেইঅজানা ঈশ্বর যার অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নেই
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বা সরকারী রেজিস্ট্রেশন বা বৈধতানেইনেই

এই তুলনাটি দেখায় যে, প্যাসকেলের ওয়েজার মূলত এমন একটি যুক্তি যা অন্ধ বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, এবং একই ধরনের বহু ভুয়া দাবির ভেতর থেকে একটি বিশেষ দাবিকে নির্বিচারে বেছে নিয়ে তার পক্ষেই সমস্ত বাজি ধরে নেয়।


গাণিতিক বিশ্লেষণ: সম্ভাবনার চোখে দেখলে

বিশ্বে বর্তমানে আনুমানিক ৪২০০টির বেশি ধর্ম ও মতবাদ রয়েছে (( World Christian Encyclopedia, 2001 ))। প্রতিটি ধর্ম নিজেকে ‘একমাত্র সত্য’ দাবি করে এবং অন্যদের মিথ্যা বলে। সুতরাং এর পেছনে সম্ভাব্যতা:

আপনি যদি বিনা তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তিতে একটি ধর্মে বিশ্বাস করেন, তবে তার সত্য হওয়ার সম্ভাবনা:

P(সঠিক ধর্ম) = 1 / 4200 ≈ 0.000238 বা ০.০২৩৮%

এখন যদি আপনি ইসলাম বেছে নেন, তাহলেও সমস্যা শেষ নয়।

ইসলামেও ৭২ ফেরকা বা উপদল:

মুহাম্মদের হাদিস অনুযায়ী:

“আমার উম্মত ৭৩টি দলে বিভক্ত হবে, তার মধ্যে ৭২টি জাহান্নামে যাবে, একটি দল জান্নাতে যাবে।” (( Tirmidhi 2641, Abu Dawood 4596 ))

অর্থাৎ ইসলামের মধ্যে আরও ৭২টি ভুয়া কোম্পানি রয়েছে, আর মাত্র একটি প্রকৃত!

সেক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা:

P(সঠিক ইসলামি ফেরকা) = 1 / 4200 × 1 / 73 = 1 / 306600 ≈ 0.00000326 বা ০.০০০৩২৬%

অর্থাৎ আপনি ইসলাম ধর্মের একটি ফেরকাকে সত্য ধর্মবিশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করলে ৯৯.৯৯৯৭৪% সম্ভাবনা হচ্ছে, আপনি ভুল ধর্ম বা ভুল ফেরকায় থাকছেন। অর্থাৎ আপনার জাহান্নামে যাওয়ার সম্ভাবনা ৯৯.৯৯৯৭৪%।


প্যাসকেলের ওয়েজারে কুযুক্তির ব্যবহার (Logical Fallacies)

  • False Dilemma (ভ্রান্ত দ্বৈত পছন্দ): ওয়েজার ধরে নেয় শুধু “বিশ্বাস” বা “অবিশ্বাস”—অথচ বাস্তবে বহু ধর্ম ও মতবাদ রয়েছে।
  • Appeal to Fear (ভয়ের ওপর নির্ভর): যদি বিশ্বাস না করো, নরকে যাবে—তাই ভয় দেখিয়ে বিশ্বাস অর্জন।
  • Ignoring the Possibility of Multiple Gods: শুধু ইসলাম নয়, ভগবান, যীশু, থর, অমিত্রা, ওডিন—সবার নিজস্ব শাস্তি ও পুরস্কার ব্যবস্থা রয়েছে।
  • Pragmatism ≠ Truth: কোনও কিছু ব্যবহারিকভাবে লাভজনক হলেও তা সত্য নাও হতে পারে।

গাণিতিক সম্ভাব্যতা ও সিদ্ধান্ত তত্ত্বের ব্যবহার

প্যাসকেল তার যুক্তিতে একটি সরল লাভ-ক্ষতির ক্যালকুলেশন দাঁড় করিয়েছিলেন: যদি তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো এবং ঈশ্বর থেকে থাকেন, তবে তুমি অসীম পুরস্কার পাবে (স্বর্গ); আর যদি ঈশ্বর না থাকেন, তাহলে কিছুই হারাবে না। অথচ বিশ্বাস না করলে, এবং ঈশ্বর থাকেন, তাহলে তুমি চিরন্তন শাস্তির মুখোমুখি হবে। এই যুক্তিটি সিদ্ধান্ত তত্ত্ব (decision theory) ও প্রত্যাশিত উপযোগিতা (expected utility) তত্ত্বের মতো দেখতে মনে হলেও, এতে কিছু গুরুতর গাণিতিক সমস্যা রয়েছে।

অসীম লাভ বনাম সীমিত সম্ভাবনা

ধরা যাক,

  • ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে লাভ: ∞ (স্বর্গ)
  • বিশ্বাস না করলে ক্ষতি: ∞ (নরক)
  • ঈশ্বর আছেন এমন সম্ভাবনা: P
  • ঈশ্বর নেই এমন সম্ভাবনা: 1 – P

সুতরাং প্রত্যাশিত উপযোগিতা বা Expected utility হবে:

E(belief) = P × ∞ + (1 – P) × finite loss = ∞

সুতরাং যেকোনো P > 0 এর জন্য belief-এ যাওয়াই "উত্তম" বলে মনে হয়।

কিন্তু সমস্যা হলো, গাণিতিক সম্ভাব্যতায় অসীম মান যুক্ত করলে তা ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত দেয় না। “∞” একটি কার্যকর গাণিতিক মান নয়—এটি এক ধরণের অধিবাচ্য মান (non-converging)। তাই অসীম উপযোগিতা ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নেয়া বিজ্ঞানসম্মত বা গণিতসঙ্গত নয়।


"Many Gods Objection" এবং সম্ভাব্যতা বিভাজন

যদি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, শিখ এবং অন্যদের ঈশ্বর আলাদা হয়, তাহলে ঈশ্বর থাকলেও কোন ঈশ্বর? প্রত্যেক ঈশ্বরের স্বর্গে পৌঁছাতে ভিন্ন পথ অনুসরণ করতে হয়। বাস্তবে বহু ধর্ম রয়েছে, প্রতিটিই নিজ নিজ ঈশ্বর বা মুক্তির পথ দাবি করে। যদি ধরেও নেই যে একটি ধর্ম সঠিক, তাহলে একাধিক বিকল্প হয়:

  • Elohim → ইহুদি ধর্মের ঈশ্বর
  • Allah → ইসলামের ঈশ্বর
  • Shiva → হিন্দুধর্মের ঈশ্বর
  • Zeus → প্রাচীন গ্রিকদের দেবতা
  • None → কোনো ঈশ্বরই নেই (নাস্তিকতা বা ধর্মনিরপেক্ষ)

তাহলে সম্ভাব্যতা নির্ধারণ হবে:

P(Elohim) = 0.2, 
P(Allah) = 0.2,
P(Shiva) = 0.2,
P(Zeus) = 0.2,
P(None) = 0.2

তাহলে একটিতে বিশ্বাস করলেই বাকিগুলোর দৃষ্টিতে তুমি "ধর্মত্যাগী" বা "কুফরী" হিসেবে গন্য হবে। এখানে খুবই সরলীকৃতভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে, যদি আমাদের হাতে কোনো প্রমাণ বা যুক্তি বা নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকে তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি প্রতিটি সম্ভাবনারই সমান সুযোগ (২০%)।

  • P(Elohim) = 0.2: ইহুদি ধর্মের ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা ২০%
  • P(Allah) = 0.2: ইসলামের ঈশ্বরের সম্ভাবনা ২০%
  • P(Shiva) = 0.2: হিন্দুধর্মের ঈশ্বরের সম্ভাবনা ২০%
  • P(Zeus) = 0.2: গ্রিক দেবতার সম্ভাবনা ২০%
  • P(None) = 0.2: কোনো ঈশ্বর নেই, এই সম্ভাবনাও ২০%

বিঃদ্রঃ এটি কোনো চূড়ান্ত বাস্তব পরিসংখ্যান নয়, বরং একটি thought experiment — দেখানোর জন্য যে, প্যাসকেল যেভাবে সম্ভাব্যতা হিসেব করেছেন তা পক্ষপাতদুষ্ট (biased)। তিনি কেবল খ্রিস্টান ঈশ্বরের লাভ-ক্ষতির হিসাব দিয়েছেন, কিন্তু অন্য ধর্ম বা ঈশ্বরের ক্ষেত্রে যদি একই রকম শাস্তি বা পুরস্কার থাকে, তাহলে পুরো ক্যালকুলেশন পাল্টে যায়।

যদি অসীম ক্ষতির সম্ভাবনা সব ধর্মেই থাকে, তাহলে কোনটাতে বিশ্বাস করাও একরকম ঝুঁকিপূর্ণ। তাই প্যাসকেলের যুক্তি এই সমস্যা কাটাতে সম্পূর্ণ অক্ষম।


সত্য কি শুধুই লাভজনক হতে হবে?

সত্য (truth) এবং উপকারিতা (utility) সমার্থক নয়। কিছু সত্য অপ্রিয় হতে পারে, কিছু মিথ্যা হতে পারে খুবই স্বস্তিদায়ক। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি আত্মপ্রতারণামূলক ভাবে বিশ্বাস করে যে তার খুব প্রিয়জন যেমন মা, তিনি মারা গেছেন কিন্তু সত্যিকার ভাবে মারা যায়নি, তাতে তার মনে শান্তি আসতে পারে, কিন্তু সেটি সত্য নয়। তার মা মারা না যাওয়া তার জন্য যত স্বস্তিদায়ক এবং প্রত্যাশিতই হোক না কেন, সত্য হচ্ছে তার মা মারা গেছেন এবং আর কোনদিনই ফিরে আসবেন না।

তেমনি ঈশ্বরে বিশ্বাস এনে দিতে পারে আত্মিক শান্তি, মানসিক স্বস্তি, এক ধরনের আশ্বাস, এক ধরনের আশা, কিন্তু প্রত্যাশা ≠ সত্য


ঈশ্বর সম্পর্কে ধার্মিকদের মনোভাব

প্যাসকেলের বাজি এবং তার প্রস্তাবিত ঈশ্বরের চরিত্রের ধারণা আস্তিকদের মধ্যে ঈশ্বর সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট মনোভাব তৈরি করে, যা অনেক ক্ষেত্রেই ঈশ্বরের প্রকৃত চরিত্রের সাথে সাংঘর্ষিক। যারা এই যুক্তিটি ব্যবহার করেন, তারা কি আসলেই মনে করেন যে, ঈশ্বর এতটা সংকীর্ণ মানসিকতার হতে পারেন যে, শুধুমাত্র তাঁকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের জন্য কাউকে চিরস্থায়ী পুরস্কার বা শাস্তি প্রদান করবেন? ঈশ্বর যদি এতটাই রূঢ় ও প্রতিশোধপরায়ণ হন যে, তিনি শুধু নিজের অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য কাউকে অনন্তকাল শাস্তি দেন, তবে তা তাঁর ন্যায়পরায়ণতা ও করুণাময় বুদ্ধিমান সত্তার ধারণার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে পড়ে। অনেক আস্তিকের মতে, ঈশ্বর একজন মহান ও মহৎ সত্তা, যিনি মানুষের কর্ম, চরিত্র, এবং চিন্তাশক্তির ওপর ভিত্তি করে বিচার করেন। এমনও তো হতে পারে যে, কেউ যুক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি, এবং বিবেকের আলোকে ঈশ্বরে অবিশ্বাস করছে, আর ঈশ্বর তাতে আনন্দিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, মানুষটি অন্তত সততার সাথে সব যুক্তি-প্রমাণ যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এমনকি সিদ্ধান্তটি ভুল হলেও, তার সত্যের প্রতি নিষ্ঠা তো প্রশ্নাতীত! হয়তো, ঈশ্বর সেই সব সৎ চিন্তাশীল ও যুক্তিসঙ্গত মানুষকে এমনভাবে মূল্যায়ন করবেন, যা অন্ধ বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে করবেন না। বরঞ্চ সেই ঈশ্বর হয়তো অন্ধবিশ্বাসী মানুষদেরই জাহান্নামে দেবেন, যারা এরকম বাজি ধরে অসৎ পন্থায় স্বর্গে যেতে চাইছে। তিনি হয়তো সেইসব বুদ্ধিমান যুক্তিবাদী নাস্তিকদেরকেই নিজের আপন মনে করবেন, কারণ ঈশ্বরের প্রস্তাবনাই হচ্ছে, তিনি একজন অসীম বুদ্ধিমান চিন্তাশীল সত্তা, যিনি নিজে একজন নাস্তিক। অর্থাৎ তিনিও তার কোন স্রস্টায় বিশ্বাসী নন।

অর্থাৎ, ঈশ্বরের কাছে হয়তো তাঁকে বিশ্বাস করা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, বরং ব্যক্তির যুক্তি, মেধা, নৈতিকতা, সৎ চিন্তাভাবনা, এবং মানবকল্যাণমূলক কার্যক্রমই অধিকতর মূল্যবান। যদি কেউ ঈশ্বরে বিশ্বাস না করে সততার সাথে ঈশ্বরের সপক্ষে যেসকল দাবীগুলো আছে সেগুলো পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, ঈশ্বরের ধারনা একটি অযৌক্তিক কুসংস্কার মাত্র, কিন্তু তিনি যদি সৎ, ন্যায়পরায়ণ, এবং মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকেন, তবে ঈশ্বরের মতো মহান সত্তা তাঁকে শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে তাঁর মেধা, যুক্তি ও জ্ঞানের ব্যবহার, একইসাথে সৃষ্টির গুণাবলীর জন্য পুরস্কৃতও করতে পারেন। সুতরাং, প্যাসকেলের যুক্তিতে উপস্থাপিত ঈশ্বরের সংজ্ঞাটি আসলে ঈশ্বরকে সংকীর্ণ মানসিকতার এক সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করে, যিনি সামান্য বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জন্য অনন্তকাল শাস্তি দিতে সক্ষম। এতে ঈশ্বরকে একজন মহান, শুভ, ও উদার চরিত্রের পরিবর্তে আত্মকেন্দ্রিক, হিংসুটে, এবং বদমেজাজি এক সত্তা হিসেবে চিত্রিত করা হয়।


সত্যিকার বিশ্বাসের অভাব বা Game Theory

প্যাসকেলের বাজির একটি মৌলিক ত্রুটি হলো, এটি বিশ্বাসকে একটি জোরপূর্বক প্রয়োগযোগ্য বিষয়ে পরিণত করে এবং বিশ্বাসকে নিয়ে এক ধরণের বাজি ধরতে বলে। প্রকৃতপক্ষে, বাজি ধরা কখনো প্রকৃত বিশ্বাস হতে পারে না। বিশ্বাস হলো একটি অভ্যন্তরীণ অনুভূতি, যা স্বতঃস্ফূর্ত এবং নিরপেক্ষভাবে মনের গভীর থেকে আসে। কিন্তু প্যাসকেলের যুক্তি অনুসারে, ব্যক্তি যদি শুধুমাত্র পরকালের পুরস্কারের আশায় ঈশ্বরে আসলে সত্যিকারের বিশ্বাস স্থাপন না করে তা পক্ষে বাজি ধরে, তবে সেটি কোনো সত্যিকারের বিশ্বাস নয়। এটি একটি নিছক প্রয়োজনে গড়া কৃত্রিম বিশ্বাস, যা ঈশ্বরের প্রতি কোনো প্রকৃত অনুভূতির প্রতিফলন নয়। এই ধরনের কৃত্রিম বিশ্বাসকে অনেক দার্শনিক মুনাফিকতা বা হিপোক্রেসির প্রতীক হিসেবে গণ্য করেছেন, যা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস এমনভাবে কাজ করে না যে, আপনি সুযোগের ওপর নির্ভর করে হঠাৎ করে বাজি ধরে বাজি জিতবেন।

প্যাসকেলের যুক্তিতে বিশ্বাসকে একটি বাজির মতো হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে জেতার এবং হারের সম্ভাবনা রয়েছে। এটি একটি সরলীকৃত গেম থিওরির (Game Theory) মতো উপস্থাপিত হয়েছে, যেখানে পরিণাম নির্ধারণ করা হয় লাভ ও ক্ষতির ভিত্তিতে। কিন্তু বিশ্বাস একটি আত্মিক ও অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া, যা লাভ ও ক্ষতির ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে পারে না। বিশ্বাস হলো আত্মার অনুভূতির একটি প্রকারভেদ, যা নৈতিকতা, আবেগ, এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে গঠিত হয়। সুতরাং, বিশ্বাসকে একটি বাজির মতো গণ্য করা আত্মিক বিশ্বাসের প্রকৃত ধারণার বিপরীত।


অনন্ত পুরস্কার ও শাস্তির অপূর্ণ ধারণা

প্যাসকেলের যুক্তিতে "অসীম পুরস্কার" এবং "অসীম শাস্তি" ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে, যা অযৌক্তিক এবং অর্থহীন। নীতিগতভাবে কোন শাস্তি বা কোন পুরষ্কারই কখনো "অসীম" হতে পারে না, হলে সেটি আর ন্যায় বিচার থাকে না। একটি সীমাবদ্ধ জীবনে সীমিত সময়ের জন্য বিশ্বাস স্থাপন করে পরকালে অসীম পুরস্কার পাওয়া কিংবা অসীম শাস্তি ভোগ করা যৌক্তিকভাবে একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ধারণা। এতে পরিমাপের তত্ত্ব (Theory of Measure) এবং ন্যায়বিচারের নীতিমালা লঙ্ঘিত হয়। কারণ, একটি সীমিত ক্রিয়ার জন্য অসীম পরিমাণ শাস্তি বা পুরস্কার দেওয়া কোনোমতেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। ন্যায়বিচারের সাধারণ নিয়ম অনুসারে, অপরাধ বা কৃতিত্বের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি বা পুরস্কার দেওয়া উচিত। যেখানে সেই মাত্রাটি থাকে না, শাস্তি বা পুরষ্কার অসীম হয়ে যায়, সেখানে ন্যায় বিচার থাকতে পারে না। সুতরাং, প্যাসকেলের যুক্তির এই অসীমতার ধারণা যৌক্তিকভাবে অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ।


সম্ভাব্যতা তত্ত্বের ভুল প্রয়োগ

প্যাসকেলের বাজির আরেকটি বড় সমস্যা হলো এতে সম্ভাব্যতা তত্ত্বের (Probability Theory) ভুল প্রয়োগ করা হয়েছে। প্যাসকেল তার যুক্তিতে ধরে নিয়েছেন যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাব্যতা ৫০%, অর্থাৎ ঈশ্বর হয় আছেন বা নেই—এভাবে শুধুমাত্র দুটি সম্ভাব্য বিকল্পের কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবিকভাবে, প্রোবাবিলিটির ক্যালকুলেশনের জন্য সম্ভাব্য সকল পরিস্থিতি প্রমাণিত হতে হয়। কোন একটি পরিস্থিতির বাস্তব প্রমাণ ছাড়া এই পরিমাণ করা সম্ভব নয়। যেমন ধরুন, আমি বললাম, "আমার ব্যাংক একাউন্টে ইলন মাস্কের চাইতে দশগুণ টাকা আছে। " - এই তথ্যটি সত্য হওয়ার সম্ভাবনা কতভাগ? ৫০%-৫০%? অর্থাৎ, আমি যদি বলি, সেই পরিমাণ অর্থ আমার ব্যাংক একাউন্টে থাকার ৫০% সম্ভাবনা আছে, তাহলে কথাটি কী অর্থ বহন করে? সেটি কিন্তু সত্য নয়। এখানে প্রবাবিলিটির ক্যালকুলেশন করতে গেলে অবশ্যই, সম্ভাব্য পরিস্থিতি কি কি হতে পারে, তার বাস্তব প্রমাণাদি লাগবে।

ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যানিক মাপকাঠি বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই, কারণ এটি একটি ধর্মীয় বিষয় যা পরিমাপযোগ্য তথ্যের আওতায় পড়ে না। প্যাসকেলের এই ধারণা হলো একটি "বাইনারি ফলাফলের সম্ভাবনা" নির্ধারণ করার প্রচেষ্টা, যা প্রকৃতপক্ষে সম্ভাব্যতা তত্ত্বের মূলনীতির পরিপন্থী। সম্ভাব্যতা তত্ত্বে কোনো একটি ঘটনার সম্ভাবনা নির্ধারণ করার জন্য সেই ঘটনার সব সম্ভাব্য বিকল্পের, যার বাস্তব অস্তিত্ব প্রমাণিত, তার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়। কিন্তু প্যাসকেল এখানে শুধুমাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের ক্ষেত্রে ৫০-৫০ ভাগের মাপকাঠি ধরে নিয়েছেন, যা একেবারেই অসঙ্গত ও ত্রুটিপূর্ণ। যেখানে একটি পরিস্থিতি, ঈশ্বর যে আছেন, তার সপক্ষে সামান্য কোন প্রমাণ মেলে না। তাছাড়া, যদি আমরা প্যাসকেলের যুক্তি অনুসরণ করে সম্ভাব্যতা নির্ধারণ করতে চাই, তবে আমাদের সমস্ত সম্ভাব্য ঈশ্বরের ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস, এবং তাদের প্রাসঙ্গিক শাস্তি ও পুরস্কারের ধারণাকে একত্রিত করতে হবে। এর ফলে সম্ভাব্যতার হিসাব আরো জটিল হয়ে যাবে এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা ৫০% থেকে অনেক কমে যাবে, কারণ এতে প্রতিটি সম্ভাব্য বিকল্পের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে হবে। এভাবে, প্যাসকেলের বাজিতে সম্ভাব্যতা তত্ত্বের ভুল প্রয়োগ হওয়ার কারণে তার যুক্তি বাস্তবিক এবং দার্শনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।


বিশ্বাসের উদ্দেশ্য ও নৈতিকতা

প্যাসকেলের বাজির আরেকটি গুরুতর সমস্যা হলো এতে বিশ্বাসের উদ্দেশ্য ও নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। প্যাসকেলের যুক্তি অনুযায়ী, একজন মানুষকে ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে শুধুমাত্র পরকালীন পুরস্কারের আশায় অথবা শাস্তি এড়ানোর জন্য। এই যুক্তির মাধ্যমে বিশ্বাসকে একটি স্বার্থপর এবং আত্মকেন্দ্রিক কার্যকলাপে পরিণত করা হয়েছে, যেখানে মূল লক্ষ্য হলো নিজেকে রক্ষা করা বা পুরস্কার লাভ করা। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বাস একটি ব্যক্তির আন্তরিক অনুভূতি হতে পারে, যুক্তি বিবেক মানবিকতা ও সত্যের অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হওয়া উচিত। যদি কোনো ব্যক্তি শুধু পরকালে পুরস্কার পাওয়ার জন্য ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করে, তাহলে সেটি আর নৈতিক বিশ্বাস থাকে না, বরং তা লাভ-ক্ষতির নিরিখে গঠিত একটি প্রয়োজনীয়তার মনোভাব, যা মুনাফিকতার (hypocrisy) সমান। এমন বিশ্বাস প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের প্রতি সৎ এবং আন্তরিক ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা নয়, বরং নিজস্ব স্বার্থরক্ষার কৌশল হিসেবে কাজ করে। এই ধরনের বিশ্বাসের নৈতিক মূল্য বা ন্যায়পরায়ণতা প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ এটি দয়া, মমতা, এবং সততা থেকে উদ্ভূত নয়, বরং ব্যক্তির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও স্বার্থরক্ষার তাগিদে উদ্ভূত। ফলে, প্যাসকেলের বাজি যে বিশ্বাসের কথা প্রচার করে, তা আসলে বিশ্বাসের প্রকৃত রূপকে বিকৃত করে এবং নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ চিন্তাধারা হিসেবে বিবেচিত হয়।


উপসংহার

প্যাসকেলের বাজি প্রথমে যুক্তিপূর্ণ মনে হলেও, এটি বাস্তবিকভাবে এবং দর্শনগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এটি বিশ্বাসকে একটি বাজির মতো উপস্থাপন করে, যা আন্তরিক কোন বিশ্বাসের প্রকৃত স্বরূপের পরিপন্থী। পাশাপাশি, বহুধর্মীয়তার সমস্যা, সত্যিকার বিশ্বাসের অভাব, এবং অসীম পুরস্কার ও শাস্তির ধারণার মতো বেশ কিছু ত্রুটি রয়েছে এতে। এই ত্রুটিগুলো বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, প্যাসকেলের বাজি একটি সম্পূর্ণ ও সঠিক যুক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং, এটি একটি অযৌক্তিক চিন্তা যা বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের প্রশ্নে কোন সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হয়। আসুন শেষে একটি ভিডিও দেখে নিই,

https://youtu.be/s4Q97V6gSYc

আরও একটি ভিডিও,

https://youtu.be/0FuWXRLrd0U