দার্শনিকরা দীর্ঘদিন ধরে ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান হওয়ার ধারণা নিয়ে আলোচনা করে আসছেন। এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ ও সাধারণ প্রশ্ন: “ঈশ্বর কি এমন একটি পাথর তৈরি করতে পারেন যা তিনি নিজেই উত্তোলন করতে পারবেন না?” এই প্রশ্নটি আপাতদৃষ্টিতে একটি সাধারণ প্রশ্ন মনে হলেও, এর গভীরে রয়েছে এক ধরনের যুক্তিগত দ্বন্দ্ব, যা প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিকদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এই প্যারাডক্সটি "ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তা" ধারণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই প্রবন্ধে আমরা সেই প্রশ্নের মূল বিষয়বস্তু এবং এর সমাধানের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করবো। আমরা মূলত থমাস অ্যাকুইনাসের চিন্তাধারা এবং অন্যান্য দার্শনিক ধারণার ভিত্তিতে বিষয়টি আলোচনায় আনবো।
প্যারাডক্সের সঠিক বাংলা হলো "প্রতিকথন" বা "স্ববিরোধ"। এটি এমন একটি ধারণা বা প্রস্তাবনা বোঝায়, যা আপাতদৃষ্টিতে সঠিক মনে হয় কিন্তু গভীরে গেলে একটি অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব বা বিরোধিতা প্রকাশ করে। দার্শনিক প্যারাডক্সগুলো প্রায়ই গভীর চিন্তার উদ্রেক করে এবং অনেক সময় বাস্তবতাকে নতুন আলোকে দেখতে বাধ্য করে। প্যারাডক্সগুলোকে ব্যবহার করা হয় দর্শনের জগতে বিভিন্ন প্রস্তাবনার সত্যতা বা মিথ্যাতা যাচাইয়ের জন্য। প্যারাডক্স সাধারণ চিন্তায় ব্যবহৃত নিয়ম ও ধারণাগুলোর সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে এবং এই সীমাবদ্ধতাগুলো আমাদের দার্শনিক বিশ্লেষণের কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
উদাহরণ ১: ডোনাল্ড ট্রাম্পের ধনসম্পদ
উদাহরণ ২: ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তা
উদাহরণ ৩: ঈশ্বরের আত্মহত্যা
ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তার ধারণাকে যাচাই করতে এই প্রশ্নটি অত্যন্ত কার্যকর। প্রশ্নটি মূলত এইভাবে উত্থাপিত হয়: যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হন, তবে কি তিনি এমন একটি পাথর তৈরি করতে পারেন যা তিনি নিজেই উত্তোলন করতে পারবেন না? এই প্যারাডক্সটি দুই ধরনের ফলাফলের দিকে নিয়ে যায়, এবং উভয় ক্ষেত্রেই ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান হওয়ার ধারণাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এই প্রশ্নটি ঈশ্বরের ক্ষমতার একটি সীমা তৈরি করে। যদি ঈশ্বর এমন একটি পাথর তৈরি করতে না পারেন যা তিনি নিজেই উত্তোলন করতে পারবেন না, তাহলে তিনি সর্বশক্তিমান নন। আবার, যদি তিনি সেই পাথর তৈরি করেন এবং তা উত্তোলন করতে না পারেন, তাহলে তিনি তখনও সর্বশক্তিমান নন। এই দ্বন্দ্বই প্যারাডক্সের মূল কারণ।
এই প্যারাডক্সের মূল প্রশ্নটি আসলে ঈশ্বরের ক্ষমতার প্রকৃতি সম্পর্কে। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হলে তার ক্ষমতার কোনও সীমা থাকা যৌক্তিক নয়। কিন্তু, এই প্যারাডক্সটি সেই ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করে। ঈশ্বর যদি সত্যিকার অর্থে সর্বশক্তিমান হন, তবে তার ক্ষমতার কোনো যৌক্তিক বা লজিক্যাল সীমা থাকা অসম্ভব। তবে, একটি প্রশ্ন থেকে যায়: সব ধরনের কাজ কি করা সম্ভব? যেমন, যুক্তিগতভাবে অসম্ভব কিছু কি আদৌ সম্ভব? সেটি না হলে, ঈশ্বর কি যুক্তির নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ? অর্থাৎ ঈশ্বর কী প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন, নাকি প্রাকৃতিক নিয়ম তার অধীন?
কিছু দার্শনিক মনে করেন যে, যুক্তিগতভাবে অসম্ভব কিছু ঈশ্বরের ক্ষমতার বাইরে। অর্থাৎ ঈশ্বর যুক্তির অধীন। যেমন, একটি গোলককে একই সময়ে চতুর্ভুজ করা সম্ভব নয়। একইভাবে, একটি পাথরকে ঈশ্বরের উত্তোলন ক্ষমতার বাইরে হওয়া একটি স্ববিরোধী ধারণা তৈরি করা, যা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ঈশ্বর এমন একটি কাজ করতে পারেন না যা স্ববিরোধী বা যুক্তিগতভাবে অসম্ভব। এই পরিস্থিতিতে দেখা যায়, ঈশ্বরের ক্ষমতা যুক্তির নিয়মের অধীনে থাকে। প্রখ্যাত দার্শনিক এবং ধর্মতত্ত্ববিদ থমাস অ্যাকুইনাস তার "Summa Theologica" গ্রন্থে ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান ধারণার সীমা নির্ধারণ করেছেন। তার মতে, ঈশ্বর এমন কিছু করতে পারেন না, যা তার নিজের প্রকৃতির বিরোধী, যেমন মিথ্যা বলা বা নিজেকে অস্বীকার করা বা নিজেকে হত্যা করা। (( Aquinas, T. 1265-1274, Summa Theologica ))
থমাস অ্যাকুইনাসের মতে, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হলেও তিনি যুক্তিসঙ্গত নিয়মের বাইরে কিছু করতে পারেন না। অ্যাকুইনাস যুক্তি দেন যে, ঈশ্বরের ক্ষমতা শুধুমাত্র যুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তিনি যুক্তির নিয়মগুলোকে সম্মান করেন। তিনি বলেছেন, "যে কোনো সত্তা যা তার নিজের সত্তার বিরুদ্ধে যায়, সেটি ঈশ্বরের ক্ষমতার বাইরে।"
অ্যাকুইনাসের মতে, ঈশ্বরের ক্ষমতার একটি সীমা রয়েছে, যা যুক্তির অধীনে থাকে। তিনি আরও যুক্তি দেন যে, ঈশ্বরের ক্ষমতা তার প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। সুতরাং, যদি ঈশ্বর এমন একটি পাথর তৈরি করেন যা তিনি উত্তোলন করতে পারেন না, তাহলে সেই কাজটি ঈশ্বরের প্রকৃতির সঙ্গে বা প্রাকৃতিক নিয়মকানুনের সাথে সাংঘর্ষিক হবে।
আস্তিকদের বর্তমান সময়ের একটি দাবী হচ্ছে, সর্বশক্তিমান হওয়ার ধারণাটি এই প্যারাডক্সে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সর্বশক্তিমান হওয়া বা সব করতে পারা মানে অযৌক্তিক বা যুক্তিসংগতভাবে অসম্ভব কাজ করতে পারা নয়। এক্ষেত্রে যুক্তি, প্রাকৃতিক নিয়মাবলী এবং বাস্তবতার ভিত্তিতে ঈশ্বরের ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারিত হয়। যেমন, ঈশ্বর একটি চতুর্ভুজাকৃতি বৃত্ত তৈরি করতে পারবেন না, কারণ এটি যুক্তিগতভাবে অসম্ভব এবং প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে। একইভাবে, "ঈশ্বরের উত্তোলন ক্ষমতার বাইরে একটি পাথর তৈরি" করা যুক্তিগতভাবে অসম্ভব এবং প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে।
অন্যভাবে বলতে গেলে, এই প্যারাডক্সটি ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে। ঈশ্বরের ক্ষমতা যুক্তির ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব ঈশ্বরের নয়, যুক্তির। ঈশ্বর যদি থেকে থাকেন, তিনিও যুক্তি বা নিয়মের অধীন এবং তাকেও প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। এই প্যারাডক্সটি আসলে ঈশ্বরের প্রকৃতির বিষয়ে একটি ভুল দাবীকে খণ্ডন করে। সর্বশক্তিমান বা যা খুশি তাই করতে পারা যৌক্তিকভাবে অসম্ভব, এমনকি ঈশ্বর থাকলে তার জন্যেও অসম্ভব।
ঈশ্বরের পাথর উত্তোলন প্যারাডক্সটি দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে আস্তিক বা ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের জন্য একটি মস্তবড় চ্যালেঞ্জ। যুগযুগ ধরে ধার্মিকগণ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন, উত্তর দিতে না পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশ্ন কর্তাকে আক্রমণ করেছেন, ভয় দেখিয়েছেন, অভিশাপ দিয়েছেন। সেগুলো করা সম্ভব না হলে দার্শনিকদের অপমান অপদস্থ করতে চেয়েছেন। কিন্তু উত্তর দিতে পারেননি। পরে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান ধারণা মানে তিনি সবকিছু নয়, যুক্তিসঙ্গত কিছু। সেসব তিনি করতে পারেন যা যুক্তিসংগত এবং বাস্তবসম্মত, অর্থাৎ ঈশ্বরকেও পদার্থবিজ্ঞানের বা প্রকৃতির নিয়মের মধ্যেই থাকতে হয়। এই প্যারাডক্স আমাদের চিন্তা করতে শেখায় এবং ক্রিটিকাল থিঙ্কিং এর পথ উন্মুক্ত করে। তাই এরকম যৌক্তিক প্রশ্ন মানুষের মনে আসা এবং তা নিয়ে চিন্তা করা খুবই জরুরি।