আল্লাহর অসীম করুণাময়তা ইসলামের একটি মৌলিক বিশ্বাস। মুসলমানরা মনে করেন, আল্লাহ্ তার সৃষ্টির প্রতি অসীম দয়াশীল এবং করুণাময়। তবে, যদি আল্লাহ সত্যিই অসীম করুণাময় হন, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারেঃ কেন তিনি দোজখের মতো একটি চিরস্থায়ী শাস্তির স্থান তৈরি করেছেন? একজন সর্বদয়ালু, সর্বক্ষমতাশালী স্রষ্টা কীভাবে তার সৃষ্টিকে চিরস্থায়ী শাস্তি দিতে পারেন? এই প্রশ্নটি দার্শনিক এবং ধর্মীয় চিন্তাবিদদের দীর্ঘদিন ধরে ভাবিয়ে তুলেছে। এই প্রবন্ধে আমরা আল্লাহর অসীম করুণাময়তা এবং দোজখের অস্তিত্বের মধ্যে একটি যৌক্তিক এবং দার্শনিক অসঙ্গতি অনুসন্ধান করব।
"অসীম" শব্দটি বাংলা ভাষায় একটি বিশেষণ, যার অর্থ হলো "যার কোনো সীমা নেই" বা "সীমাবদ্ধ নয়।" শব্দটি মূলত সংস্কৃত "असीम" (asīma) শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এটি বাংলা ভাষায় এমন কিছুকে নির্দেশ করে যা অসীম, অশেষ, অন্তহীন, বা যার কোনো পরিসীমা বা সীমানা নেই। যৌক্তিকভাবে, যখনই কোন কোন কিছুর সীমানা নির্ধারিত হবে, সাথে সাথে সেটি আর অসীম থাকবে না। একইভাবে, যখনই আপনি এর শেষ নির্ধারন করতে পারবেন, এটি সাথে সাথেই অসীম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। যেকোনভাবেই যদি কোন কিছুর সীমা নির্ধারিত হয়ে যায়, তাহলে সেটি আর অসীম থাকে না। সসীম হয়ে যায়।
কিছু উদাহরণঃ
"অসীম করুণা" বলতে বোঝায় এমন একটি গুণ, যার কোনো সীমা বা পরিসীমা নেই। এটি একটি অন্তহীন গুণ, যা কোনো শর্ত বা নির্দিষ্ট পরিস্থিতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। সহজভাবে বলতে গেলে, অসীম করুণা মানে এমন একটি গুণ, যেখানে কোনো অবস্থাতেই করুণার পরিসমাপ্তি ঘটে না। বা আমরা কোনভাবেই তার সীমা নির্ধারণ করতে সক্ষম হবো না। অথবা বলা যায়, তার কোন পরিমাণ হয় না, অন্তহীন। কোন একটি পরিস্থিতিতে যদি তার সীমানা নির্ধারণ সম্ভব হয়, সাথে সাথেই সেটি সসীম হয়ে যায়। আল্লাহর করুণার ক্ষেত্রেও একই কথা সমভাবে প্রযোজ্য। যদি আমরা কোন একটি সীমা নির্ধারণ করতে পারি, সাথে সাথেই সেটি সসীম হয়ে যায়। অর্থাৎ যৌক্তিকভাবে, আল্লাহর অসীম করুণা সমস্ত সৃষ্টির প্রতি সমানভাবে প্রযোজ্য হতে হবে, পাপী কিংবা সৎ মানুষ নির্বিশেষে। কোন একটি ক্ষেত্রে যদি করুণার সীমা নির্ধারিত হয়ে যায়, সাথে সাথেই তা সসীম হয়ে যায়। অর্থাৎ যৌক্তিকভাবে অসীম দয়ালু আল্লাহর ভালো বা খারাপ যেকোনো সৃষ্টির প্রতি সমানভাবে অসীম করুণাময় হতে হবে, কোন একটি পয়েন্টে তা থেমে গেলেই, যৌক্তিকভাবে তিনি সসীম করুণাময় হয়ে যাবেন। ।
ইসলামে, দোজখকে এমন একটি স্থান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে পাপী এবং অবিশ্বাসীরা তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করবে। এই বিষয়ে অসংখ্য কোরআনের আয়াত এবং হাদিসের বর্ণনা রয়েছে, যেগুলো অন্যান্য প্রবন্ধে পাবেন। এটি একটি স্থায়ী শাস্তির স্থান, যেখানে শাস্তি ভোগ করা অসহনীয় এবং অবিরাম। যা অনন্তকাল চলতে থাকবে। এখানে প্রশ্ন আসে: যদি আল্লাহর করুণা অসীম হয়, তাহলে কেন দোজখের অস্তিত্ব রয়েছে? এর মানে কি এই নয় যে, আল্লাহর করুণা আসলে সীমাবদ্ধ? যদি তিনি করুণাময় হন, তবে তার সৃষ্টির প্রতি চিরস্থায়ী শাস্তি আরোপ করা কি করুণার বিপরীত নয়? নীতিগতভাবে কোন শাস্তি বা কোন পুরষ্কারই কখনো “অসীম” হতে পারে না। একটি সীমাবদ্ধ জীবনে সীমিত সময়ের জন্য বিশ্বাস স্থাপন করে পরকালে অসীম পুরস্কার পাওয়া কিংবা অসীম শাস্তি ভোগ করা যৌক্তিকভাবে একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ধারণা। এতে পরিমাপের তত্ত্ব (Theory of Measure) এবং ন্যায়বিচারের নীতিমালা লঙ্ঘিত হয়। কারণ, একটি সীমিত ক্রিয়ার জন্য অসীম পরিমাণ শাস্তি বা পুরস্কার দেওয়া কোনোমতেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। ন্যায়বিচারের সাধারণ নিয়ম অনুসারে, অপরাধ বা কৃতিত্বের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি বা পুরস্কার দেওয়া উচিত। যেখানে সেই মাত্রাটি থাকে না, শাস্তি বা পুরষ্কার অসীম হয়ে যায়, সেখানে ন্যায় বিচার থাকতে পারে না।
দার্শনিকভাবে, অসীম করুণা এবং শাস্তির ধারণার মধ্যে একটি মৌলিক বিরোধ বিদ্যমান। নিচের কয়েকটি যুক্তি এই বিরোধটিকে স্পষ্ট করে:
কিছু ধর্মতাত্ত্বিক এবং দার্শনিকরা যুক্তি দিয়েছেন যে, দোজখের শাস্তি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর করুণারই আরেকটি রূপ। তাদের মতে, পাপীদের শাস্তি দেওয়া এবং তাদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং চিরস্থায়ী শাস্তি ভোগ না করে। তবে, এই যুক্তি অসীম করুণার ধারণার সাথে মানানসই নয়, কারণ দোজখের শাস্তি অনন্তকাল ধরে চলবে বলে ধর্মগ্রন্থগুলো দাবী করে।
উপরের বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহর অসীম করুণাময়তা এবং দোজখের অস্তিত্বের মধ্যে একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। যদি করুণা সত্যিই অসীম হয়, তবে তার কোনো সীমা থাকা উচিত নয় এবং দোজখের মতো শাস্তির স্থান থাকা উচিত নয়। তবে, যদি দোজখের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে করুণার অসীমতাড় দাবী আর টেকে না। এই কারণে, দার্শনিকভাবে এবং যৌক্তিকভাবে আল্লাহর "অসীম করুণাময়" হওয়া একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যৌক্তিকভাবে অবাস্তব ধারণা।