"জনপ্রিয়তার কুযুক্তি" (Argument from Popularity) একটি সাধারণ যুক্তির ত্রুটি বা কুযুক্তি। এতে কোনো মতবাদ বা বিশ্বাসের যথার্থতা নির্ধারণ করা হয় তার অনুসারীর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ, যদি কোনো মতবাদে অনেক মানুষ বিশ্বাস করে, তবে সেটি সঠিক হতে হবে—এমন একটি ভিত্তিহীন ধারণা থেকে এই কুযুক্তি উদ্ভূত হয়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে, কোনো ধারণা বা মতবাদের জনপ্রিয়তা কখনোই তার সঠিকতা বা বৈধতার প্রমাণ নয়। সঠিক যুক্তি সবসময় তথ্য, প্রমাণ, এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের ওপর নয়।
দাবী: ইসলাম যদি সত্য না হয়, তাহলে ১৬০ কোটি মুসলমান কেন ইসলামে বিশ্বাস করে?
এই দাবীতে বলা হচ্ছে যে, যেহেতু ১৬০ কোটি মানুষ ইসলামে বিশ্বাস করে, তাই ইসলামকে সত্য বলে মেনে নিতে হবে। কিন্তু এ ধরনের যুক্তি একটি জনপ্রিয়তার কুযুক্তির (Argumentum ad populum) উদাহরণ। কোনো ধর্মে কতজন মানুষ বিশ্বাস করে, তা সেই ধর্মের সত্যতা নির্ধারণ করে না। একইসাথে, পৃথিবীতে ৮০০ কোটি মানুষ থাকলে বাদবাকি ৬৪০ কোটি মানুষ ইসলামকে মিথ্যা ধর্ম বলে মনে করে। তাহলে তাদের মতামত যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই তাদের মতকেই বেশি সঠিক বলে ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ, এই যুক্তি দিয়েই দেখানো সম্ভব, কেন এই যুক্তিটি একটি যুক্তির ত্রুটি বা কুযুক্তি বা হেত্বাভাস।
ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষ বহু সময় ভুল ধারণায় বিশ্বাস করেছে। যেমন, একসময় পৃথিবীকে সমতল মনে করা হতো, এবং তাতে পৃথিবীর অনেক মানুষই বিশ্বাস করত। কিন্তু, তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এর মানে হলো, বৃহৎ জনসংখ্যার বিশ্বাস কোনো ধারণার সত্যতার নিশ্চয়তা নয়।
দাবী: বিবর্তনতত্ত্ব যদি সত্য হয়, তাহলে পৃথিবীর সব আব্রাহামিক ধর্মের ধার্মিক মানুষ কেন তা অবিশ্বাস করে?
এই দাবীটিও জনপ্রিয়তার কুযুক্তির একটি উদাহরণ। এখানে বলা হচ্ছে, যেহেতু বেশিরভাগ ধর্মীয় মানুষ বিবর্তন তত্ত্বে বিশ্বাস করে না, তাই সেই তত্ত্বটি সঠিক নয়। কিন্তু, কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সত্যতা মানুষ কীভাবে তা বিশ্বাস করছে, তার ওপর নির্ভর করে না। বিবর্তনতত্ত্ব একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রমাণিত সত্য, যা প্রচুর গবেষণা ও প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষ কী মানল কী মানল না, তার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ উপাত্তের ওপর। তবে, বিশেষভাবে সেই বিষয়ের বিজ্ঞানীদের মত এবং যুক্তি এখানে গুরুত্ব বহন করে।
জনপ্রিয়তার কুযুক্তি এই ধারণার ওপর নির্ভর করে যে, যেহেতু কোনো বিশ্বাস বা ধারণায় অনেক মানুষ একমত, সেহেতু সেটি সঠিক। কিন্তু গণতন্ত্রের মতো যুক্তি বা বৈজ্ঞানিক সত্য কোনো ভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না। যদি আমরা যুক্তিকে মানুষের সংখ্যা দ্বারা পরিমাপ করি, তাহলে অনেক সময় ভুল ধারণাও সঠিক বলে প্রমাণিত হতে পারে, যা মূলত সঠিক নয়।
যখন কোনো দাবী বা মতবাদ উত্থাপন করা হয়, তখন তার সত্যতা নির্ধারণের জন্য তথ্য, প্রমাণ এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। জনপ্রিয়তা কখনো কোনো মতবাদ বা দাবীর সত্যতা নির্ধারণ করতে পারে না।
প্রকৃত সত্যের বৈশিষ্ট্য হলো এটি তথ্য, গবেষণা, ও প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। যদি পৃথিবীর মাত্র কয়েকজন মানুষও সঠিক কোনো বিষয়ের পক্ষে থাকে, এবং তারা সঠিক প্রমাণ উপস্থাপন করে, তবে সেই প্রমাণই মাপকাঠি হবে, জনসংখ্যার বিশ্বাস নয়।
"জনপ্রিয়তার কুযুক্তি" হলো একটি ত্রুটিপূর্ণ যুক্তি যা কোনো মতবাদ বা ধারণাকে তার অনুসারীর সংখ্যা দ্বারা সত্য প্রমাণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবে, কোনো ধারণার সত্যতা তার প্রমাণ ও যুক্তির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, না যে কতজন সেটাতে বিশ্বাস করে। জনসংখ্যার বিশ্বাস কোনো বৈজ্ঞানিক বা যৌক্তিক সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না, এবং সঠিকভাবে চিন্তা করলে প্রমাণ ও যুক্তিই আসল বিচারক।