08.প্রাধিকারের কুযুক্তি | Argument from authority
user
April 21, 2024
523 views
যুক্তি বনাম কুযুক্তি/ফ্যালাসি

ভূমিকা

প্রাধিকারের কুযুক্তি বা Argument from Authority হলো একটি যুক্তিক ত্রুটি, যেখানে কোনো দাবীকে প্রমাণ করার জন্য কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম, পদমর্যাদা বা অবস্থানকে ব্যবহার করা হয়। যদিও কখনো কখনো বিশিষ্ট ব্যক্তির মতামত গ্রহণযোগ্য হতে পারে, তবে শুধুমাত্র তার অবস্থান বা পরিচিতির ওপর ভিত্তি করে কোনো দাবীর সত্যতা নির্ধারণ করা যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে প্রমাণের বা যুক্তির পরিবর্তে ব্যক্তির ক্ষমতা বা খ্যাতির ওপর নির্ভর করা হয়, যা প্রকৃত সত্যতা প্রমাণ করে না।

  • উদাহরণ ১:
    • দাবী: অমুক বিজ্ঞানী ভাগ্য পরিবর্তনের আংটি পরতেন, তাই আংটি ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।
    • এখানে বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ করে দাবি করা হচ্ছে যে আংটি পরলে ভাগ্য পরিবর্তন হয়। তবে বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা অভ্যাস কোনো প্রমাণ নয় যে আংটি সত্যিই ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। বিজ্ঞান নিজেই প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, আর এখানে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই যা আংটি পরার ফলে ভাগ্য পরিবর্তনের সত্যতা নিশ্চিত করে।
  • উদাহরণ ২:
    • দাবী: অমুক দর্শনের পণ্ডিত পীরবাবার পানিপড়া খেতেন, অতএব পানিপড়া খেলে অসুখ সারে।
    • এই দাবীতে কোনো পণ্ডিত ব্যক্তির ব্যক্তিগত অভ্যাস বা বিশ্বাসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো রোগ নিরাময়ের পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক প্রমাণের মাধ্যমে যাচাই করতে হয়। পণ্ডিত ব্যক্তির আচরণকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে দাবি করা হচ্ছে পানিপড়া অসুখ সারাতে পারে, যা প্রমাণিত নয়।
  • উদাহরণ ৩:
    • দাবী: অমুক বিখ্যাত ডাক্তার ওঝার শরণাপন্ন হয়েছিলেন, অর্থাৎ ওঝা রোগ সারাতে পারে।
    • এখানে বিখ্যাত ডাক্তার কোনো ওঝার শরণাপন্ন হয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে, এবং সেই ডাক্তারকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ডাক্তার বা কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির কোনো ওঝার শরণাপন্ন হওয়া কোনোভাবেই ওঝার কার্যকারিতা প্রমাণ করে না। এটি আবারো প্রাধিকারের কুযুক্তির একটি উদাহরণ।

প্রাধিকারের কুযুক্তি: সমস্যা ও ফলাফল

প্রাধিকারের কুযুক্তিতে যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়, তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা অভ্যাসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তবে এটি একটি বড় সমস্যার কারণ। ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে কোনো যুক্তি প্রমাণ করা উচিত নয়, কারণ—

  1. ব্যক্তিগত বিশ্বাস সব সময় যৌক্তিক নয়: একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হোক না কেন, তার ব্যক্তিগত মতামত বা বিশ্বাস ভুল হতে পারে। তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা বিশ্বাস কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণের বিকল্প নয়।
  2. খ্যাতি বা প্রভাব সত্যের মানদণ্ড নয়: কোনো ব্যক্তি যতই বিখ্যাত বা বিশেষজ্ঞ হোন না কেন, তার কথার সত্যতা যাচাই করতে হলে প্রমাণ এবং যুক্তির প্রয়োজন হয়। ব্যক্তির অবস্থান সত্যতার একমাত্র নির্ধারক হতে পারে না।
  3. যুক্তির ভিত্তিতে প্রমাণ: যে কোনো দাবি প্রমাণ করার জন্য প্রমাণ এবং বিশ্লেষণ প্রয়োজন। শুধু কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কী বলেছেন, তা যুক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রাধিকারের কুযুক্তি বুঝতে কিছু ভুল ধারণা

অনেকে প্রাধিকারের কুযুক্তি ভুলভাবে বুঝতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, কোনো বিশেষজ্ঞের মতামত যদি তার গবেষণা বা পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে হয়, তবে তা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। এটি তখন আর প্রাধিকারের কুযুক্তি নয়। উদাহরণস্বরূপ:

বৈধ উদাহরণ

উদাহরণ: একজন চিকিৎসক দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে কোনো নতুন ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণ করেছেন।
এটি প্রাধিকারের কুযুক্তি নয়, কারণ চিকিৎসক তার গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন এবং তার দাবীর সপক্ষে যথাযথ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দিয়েছেন। এখানে তার পদ বা অবস্থান প্রমাণ নয়, বরং তার প্রমাণিত গবেষণা তার দাবীকে সমর্থন করে।

অযৌক্তিক উদাহরণ

উদাহরণ: একজন বিখ্যাত চিকিৎসক বলেছেন যে মন্ত্র পড়লে রোগ সেরে যায়, তাই মন্ত্র পড়া কার্যকর।
এটি প্রাধিকারের কুযুক্তি। চিকিৎসক যতই বিখ্যাত হোন না কেন, মন্ত্র পড়ার কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া প্রমাণ করা যায় না। চিকিৎসকের খ্যাতি এখানে যুক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।


আরও কিছু উদাহরণ

উদাহরণ ৪

দাবী: আলবার্ট আইনস্টাইন ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, তাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে।
এটি প্রাধিকারের কুযুক্তির উদাহরণ, যেখানে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব নির্ধারণে বিজ্ঞান, দর্শন বা ধর্মীয় প্রমাণই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে, আইনস্টাইনের বিশ্বাস নয়।

উদাহরণ ৫

দাবী: অমুক বিখ্যাত নেতা বলেছেন এই ওষুধ কার্যকর, তাই এটি সত্যিই কাজ করে।
এখানে নেতার খ্যাতি এবং অবস্থান ব্যবহার করে ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু একটি ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এবং গবেষণার প্রয়োজন হয়, কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির বক্তব্য তা প্রমাণ করতে পারে না।


উপসংহার

প্রাধিকারের কুযুক্তি হলো যুক্তির এমন একটি ত্রুটি, যেখানে কোনো বিখ্যাত বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির নাম বা মতামতকে যুক্তির প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যদিও বিশেষজ্ঞের মতামত গুরুত্ব রাখে, তা প্রমাণ হতে পারে না যদি তা প্রমাণিত যুক্তি এবং তথ্যের ওপর ভিত্তি করে না হয়। কোনো দাবী প্রমাণ করতে হলে অবশ্যই প্রমাণ, গবেষণা এবং যুক্তির প্রয়োজন, শুধুমাত্র খ্যাতি বা অবস্থানের ওপর নির্ভর করা যুক্তিসঙ্গত নয়।