ইসলামী হাদিস ও তাফসীর গ্রন্থসমূহে এমন একটি ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায় যে, পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল বলে বিবেচিত কাবা শরীফের ‘ঠিক ওপরে’ সাত আসমানের ওপরে রয়েছে একটি অলৌকিক মসজিদ — বায়তুল মামুর। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমসহ একাধিক হাদিসগ্রন্থে বর্ণিত আছে যে এটি ফেরেশতাদের উপাসনাস্থল, যা আল্লাহর আরশের নিকটে অবস্থান করে এবং কাবার প্রতিচ্ছবি হিসেবে বিবেচিত হয়। তাফসীর গ্রন্থগুলোতে বিবরণ পাওয়া যায় যে, এই মসজিদটির অবস্থান পৃথিবীর কাবার ঠিক উপরে।
এ ধরনের ধারণা মুসলিমদের মাঝে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত থাকলেও, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান এবং দর্শনের আলোকে এটি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় — বায়তুল মামুর সম্পর্কিত দাবি বাস্তবিক, ভৌত বা বৈজ্ঞানিক দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য এবং কেবল ধর্মীয় রূপকথার গল্প হিসেবে বিশ্লেষিত হওয়া উচিত। সেই বিষয়টিই এখানে আমরা আলোচনা করবো।
আসুন এই বিষয়ে আহমদুল্লাহ সাহেবের একটি বক্তব্য শুনে নিই,
তাফসীরে জাকারিয়াতে খুব পরিষ্কারভাবে বলা আছে, বায়তুল মামুর নামক আসমানি মসজিদ দুনিয়ার কাবার ঠিক উপরে রয়েছে। (( কুরআনুল কারীম, ২য় খণ্ড – ড. যাকারীয়া, পৃষ্ঠা ২৪৮২ ))
এবারে আসুন তাফসীরে মায়হারী থেকে দেখে নেয়া যাক, (( তাফসীরে মাযহারী, ১১তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২২ ))
এবারে আসুন দেখি তাফসীরে ইবনে কাসিরে কী বলা হয়েছে, (( তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড ১০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ৪৮০-৪৮১ ))
পৃথিবী একটি প্রায় গোলাকার ঘূর্ণায়মান গ্রহ। এটি প্রতি ২৪ ঘণ্টায় নিজ অক্ষে একবার ঘুরে এবং প্রতি ৩৬৫ দিনে সূর্যের চারদিকে একবার ঘোরে। ফলে পৃথিবীর যেকোনো নির্দিষ্ট স্থানের "ঠিক উপরে" বলতে কিছু নেই, কারণ এই অবস্থান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে।
যদি “বায়তুল মামুর” শব্দটি স্থানিক অর্থে “ঠিক কাবার উপরে” হয়, তাহলে এটির অবস্থানও পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণায়মান হতে হবে। কিন্তু সাত আসমানকে যদি অপরিবর্তনীয় ও চিরস্থায়ী জগৎ হিসেবে ধরা হয়, তাহলে সেখানে স্থির কোনো কিছু কাবার সাথে স্থানিকভাবে "সমান্তরাল" থাকতে পারে না।
বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, "উপরে" শব্দটি আপেক্ষিক; এটি নির্ভর করে অভিকর্ষজ এবং ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর। এই ধারণা কেবল পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে ব্যবহার করা যায়। পৃথিবীর বাইরে বা মহাকাশে ‘উপরে’ ও ‘নিচে’র কোনো অর্থ নেই। তাই “ঠিক উপরে বায়তুল মামুর” কথাটি বিজ্ঞানের ভাষায় উদ্ভট এবং অবাস্তব বক্তব্য।
প্রকৃতপক্ষে, “কাবার ঠিক ওপরে” বায়তুল মামুর নামে কোনো স্থির মসজিদের অবস্থানের ধারণাটি শুধুমাত্র প্রাচীন পৃথিবী-কেন্দ্রিক বিশ্বদর্শন বা স্তরযুক্ত মহাবিশ্বের চিন্তা কাঠামোতে অর্থবহ হতে পারে। সেই সময়ে পৃথিবীকে সমতল বা ফ্ল্যাট মনে করা হতো, যার মাঝখানে কাবা বা কোনো ধর্মীয় কেন্দ্র কল্পনা করা হত। কাবার ওপরে স্তরে স্তরে সাত আসমান বিস্তৃত, আর প্রতিটি আকাশের শেষে সর্বোচ্চ স্তরে বায়তুল মামুরের অবস্থান — এই চিন্তা এসেছে মধ্যপ্রাচ্য ও ব্যাবিলনীয় ঐতিহ্য থেকে, যেখানকার মানুষ পৃথিবীকে স্থির ভাবত এবং উপর-নিচের ধারণাকে বাস্তবিক বলে ধরে নিত।
এই ভূকেন্দ্রিক ও স্তরযুক্ত বিশ্বকল্পনায় পৃথিবীর আকাশ ও ঈশ্বরের আসন পর্যন্ত সবকিছু স্তরাকারে সাজানো ছিল। তাই মক্কার স্থির কেন্দ্রের ঠিক উপরে বায়তুল মামুরের অবস্থান কল্পনা করা তাদের কাছে একধরনের ধর্মীয় বাস্তবতা ছিল। আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী, যেখানে পৃথিবী একটি গোলাকার ঘূর্ণায়মান গ্রহ এবং মহাবিশ্ব একটি একক ও স্তরহীন স্পেস-টাইম ধারাবাহিকতা, সেখানে এই আকাশস্তর ও "ঠিক উপরে" মসজিদের অস্তিত্ব শুধু অসম্ভব নয়, বরং আদিম বিশ্বদর্শনের একটি ভুল ধারণা হিসেবেই দেখা উচিত।
বিঃদ্রঃ ভিডিওচিত্রগুলো AI ব্যবহার করে তৈরি, তাই বানান ভুল থাকা অসম্ভব নয়।
ইসলামী ধর্মতত্ত্বে সাত আসমান একটি জনপ্রিয় ধারণা — আলাদা আলাদা স্তরবিশিষ্ট আসমান, যেখানে বিভিন্ন স্তরে ফেরেশতা, নবী ও দেবদূত অবস্থান করেন। কিন্তু আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুযায়ী মহাবিশ্ব একটি ধারাবাহিক ও একক মহাশূন্য (space-time continuum) যা বিগ ব্যাং (Big Bang) এর মাধ্যমে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে সৃষ্ট হয়েছে।
আজ পর্যন্ত আমরা কেবল একটিই মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছি। সেখানে “সাত আসমান” জাতীয় কোনো ভিন্ন স্তরের কাঠামো দেখা যায়নি। এমনকি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল, ট্রপোস্ফিয়ার, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার, ইত্যাদি স্তরও প্রকৃত অর্থে ধর্মীয় আসমানের ধারণার সাথে মেলে না।
নাসা, ইএসএ (ESA), এবং অন্যান্য গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী মহাবিশ্বের কোনও অংশেই "স্তরবিশিষ্ট আকাশ" বা সেখানে কোনো "মসজিদসদৃশ নির্মাণ" চিহ্নিত হয়নি। (( NASA Cosmology 101, European Space Agency Archives ))
যদি বায়তুল মামুর একটি বস্তুগত বা পদার্থে গঠিত স্থাপনা হয়, তবে সেটিকে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে কোথাও না কোথাও ঘূর্ণায়মান বা গতিশীল হতে হবে। এমনকি একটি কৃত্রিম উপগ্রহও পৃথিবীর কক্ষপথে থাকলে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসে বা ধ্বংস হয়। অন্যদিকে, যদি দাবি করা হয় এটি একটি অদৃশ্য বা অলৌকিক কাঠামো, তবে সেটি কাবার ‘ঠিক উপরে’ থাকার দাবি অনর্থক, কারণ অবাস্তব জগতের সঙ্গে স্থানিক সংযোগ তৈরি করাই যুক্তিহীন।
“কাবা পৃথিবীর কেন্দ্র” এবং “তার ঠিক ওপরে রয়েছে বায়তুল মামুর” — এ ধরনের ধারণা এসেছে এমন এক সময় থেকে, যখন পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র মনে করা হতো। প্রাচীন গ্রিক, হিন্দু ও মধ্যযুগীয় ইসলামি বিশ্ববীক্ষায় এই ভূকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি (geocentrism) ছিল প্রবল।
কিন্তু কোপারনিকাস, গ্যালিলিও এবং নিউটনের যুগ থেকে আমরা জানি যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে আবর্তিত হয় এবং এটি মহাবিশ্বের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশমাত্র। আজকের বৈজ্ঞানিক যুগে, ধর্মীয় ঐতিহ্যের এই ভূকেন্দ্রিক ও কল্পনাপ্রসূত বর্ণনাগুলোর জায়গা ইতিহাসের পাতায় হলেও থাকতে পারে — বাস্তবতার বিবেচনায় নয়।
বায়তুল মামুর নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই অনেকে ধর্মীয় অনুভূতির কথা তুলে ধরেন। কিন্তু সত্য অনুসন্ধানে অনুভূতির নয়, তথ্য ও যুক্তির প্রাধান্য থাকা উচিত। ধর্ম যদি সত্য দাবি করে, তবে সেটিকে যুক্তি ও পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, অন্ধবিশ্বাসের আড়ালে লুকিয়ে নয়।
যুক্তিনির্ভর সমাজ গঠনের জন্য আমাদের প্রয়োজন ধর্মীয় আখ্যানগুলোরও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ — যেখানে কুসংস্কার, মিথ, ও বাস্তবতার মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য টানা হয়।
বায়তুল মামুরের অস্তিত্ব বা অবস্থান সংক্রান্ত ধারণা একটি ধর্মীয় প্রতীক বা রূপক হতে পারে, কিন্তু সেটিকে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্পূর্ণ ভুল। ধর্মীয় আখ্যানের মর্যাদা থাকতে পারে তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক পরিপ্রেক্ষিতে, কিন্তু বাস্তবিক ও বৈজ্ঞানিক জগতে সেই দাবি টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ ও কঠোর পর্যালোচনা।
বিশ্বাসকে যদি সত্যের সাথে মিলিয়ে দেখা না হয়, তবে সেটি কেবল সংস্কার বা মিথ হয়ে থাকে। এ কারণে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিপরীতে যুক্তি, তথ্য ও মুক্তচিন্তার ভিত্তিতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।