আল্লাহ কি একমাত্র স্রষ্টা, না সর্বশ্রেষ্ঠ স্রষ্টা? কোরআনের পৌত্তলিক প্রভাব
user
July 14, 2025
0

সারসংক্ষেপ

ইসলামের ভিত্তিমূলক বিশ্বাস হলো আল্লাহ এক, অদ্বিতীয় এবং একমাত্র স্রষ্টা। কোরআন নিজেকে একটি পরিপূর্ণ ও স্ববিরোধহীন গ্রন্থ হিসেবে দাবি করে। কিন্তু সূরা মু’মিনুন ২৩:১৪ আয়াত এক ভিন্নতর চিত্র উপস্থাপন করে, যেখানে বলা হয়েছে, “আল্লাহ সৃষ্টিকর্তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।” এই বাক্যাংশ কোরআনের একত্ববাদী ভাষ্যের বিপরীতে দাঁড়ায় এবং একাধিক স্রষ্টার অস্তিত্বকে ইঙ্গিত করে, যা কোরআনের অন্যান্য আয়াতের স্পষ্ট অস্বীকার।

এই গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করা হবে:
(১) এই আয়াতের ভাষাতাত্ত্বিক ও ধর্মতাত্ত্বিক বৈপরীত্য,
(২) মুহাম্মদের ধর্মতাত্ত্বিক বিকাশে পৌত্তলিক প্রভাব,
(৩) স্যাটানিক ভার্সেসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট,
(৪) মক্কা ও মদিনা পর্বে “আল্লাহ” সত্তার চরিত্রগত রূপান্তর,
এবং (৫) এই সমস্ত উপাদান কীভাবে ইসলামি ঈশ্বরতত্ত্বের মৌলিকতা ও অভ্রান্ততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।


সূরা মু’মিনুন ২৩:১৪ আয়াতের পাঠ বিশ্লেষণ

উক্ত আয়াতটি নিম্নরূপ:

"فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ"
“সুতরাং ধন্য মহান আল্লাহ, যিনি সৃষ্টিকর্তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।”
—সূরা মু’মিনুন ২৩:১৪ ((Quran, 23:14))

এখানে দুটি আরবি শব্দ গুরুত্বপূর্ণ:

  • "الخالقين" (al-khaliqīn) — বহুবচন রূপ, যার অর্থ “স্রষ্টাগণ”
  • "أحسن" (ahsanu) — তুলনামূলক বিশেষণ, যার অর্থ “সবচেয়ে উত্তম” বা “সর্বশ্রেষ্ঠ”

এই বাক্যগঠন শুধুমাত্র তখনই যৌক্তিক, যখন একাধিক স্রষ্টা বিদ্যমান এবং সেই প্রেক্ষিতে একজনকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়। কিন্তু কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ নিজেকে একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে দাবি করেছেন:

“আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা।” —সূরা জুমার ৩৯:৬২
“আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো স্রষ্টা কি আছে?” —সূরা ফাতির ৩৫:৩
“তারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না, বরং নিজেরাই সৃষ্ট।” —সূরা নাহল ১৬:২০

এই তিনটি আয়াত এবং ২৩:১৪ আয়াত পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক। যদি আল্লাহ একমাত্র স্রষ্টা হন, তবে অন্য স্রষ্টা বলে কিছু নেই; সেখানে তুলনার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ২৩:১৪ আয়াতে স্পষ্টত বহুবচন ও তুলনা করা হয়েছে।


ভাষাগত অলংকার না ঈশ্বরতাত্ত্বিক বিভ্রান্তি?

অনেক ইসলামি ভাষ্যকার দাবি করেন—এটি কেবল একটি ভাষাগত অলংকার বা বাগ্বিন্যাসের সৌন্দর্য। কিন্তু এমন অলংকার যদি ঈশ্বরতত্ত্বে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, তবে সেটিকে ঈশ্বরপ্রদত্ত সর্বশ্রেষ্ঠ ও স্বচ্ছ ভাষা বলা যায় না। কোরআন নিজেই দাবি করে:

“এই কিতাবের আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাযুক্ত এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সুস্পষ্ট ভাষায় নাজিল করা হয়েছে।”
—সূরা হুদ ১১:১ ((Quran, 11:1))

যে ঈশ্বরের বানী এমন ভাষায় রচিত, যার অর্থ বোঝাতে বহু শতকের তাফসিরকারের সাহায্য নিতে হয়, সেই ভাষাকে কি স্পষ্ট বলা যায়? অলংকারের আড়ালে গৃহীত তাওহিদিক বিভ্রান্তি কি ঈশ্বরের পক্ষ থেকে কাম্য?


আয়াতটির মাক্কী পটভূমি ও পৌত্তলিক সমাজের প্রভাব

সূরা মু’মিনুন একটি মাক্কী সূরা, যা মুহাম্মদের ধর্মপ্রচারের শুরুর পর্যায়ে অবতীর্ণ। এ সময় তিনি ছিলেন আরবের পৌত্তলিক সমাজে একজন সংখ্যালঘু নবী, যেখানে কাবার চারপাশে ৩৬০টি মূর্তি পূজিত হতো এবং আল-লাত, আল-উজ্জা, ও মানাত নামে তিন নারী-দেবীকে “আল্লাহর কন্যা” বলা হতো ((Ibn Ishaq, Sirat Rasul Allah))।

এই পৌত্তলিক পটভূমির ফলে মুহাম্মদ একধরণের ধর্মতাত্ত্বিক আপস করেন—তিনি সকল দেবতাকে সরাসরি অস্বীকার না করে বরং আল্লাহকে তাঁদের মধ্যে “সর্বশ্রেষ্ঠ” হিসেবে উপস্থাপন করেন। এটি একটি হেনোথেইস্টিক (Henotheistic) অবস্থান—যেখানে বহু সত্তার অস্তিত্ব মেনে নিয়ে, একটিকে সর্বোচ্চ হিসেবে মান্য করা হয়।

এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে ২৩:১৪ আয়াতের “স্রষ্টাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ” বাক্যে।


“স্যাটানিক ভার্সেস” ঘটনার আলোকে ধর্মতাত্ত্বিক আপস

এই প্রেক্ষাপটে আলোচিত হওয়া জরুরি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হল “স্যাটানিক ভার্সেস”। ইসলামি ঐতিহাসিক গ্রন্থ (যেমনঃ আল-তাবারী, ইবনে সা’দ, ওয়াকিদি) অনুসারে, সূরা আন-নাজম পাঠের সময় মুহাম্মদ বলেছিলেন:

“এই তিন নারী দেবী—আল-লাত, আল-উজ্জা ও মানাত—উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। নিশ্চয়ই তাঁদের সুপারিশ প্রত্যাশিত।”

এই আয়াত শুনে মক্কার পৌত্তলিকরা খুশি হয়ে সিজদা করে। পরে মুহাম্মদ বলেন, শয়তান তাঁকে এই আয়াত মুখে দিয়েছিল এবং তিনি তা বাতিল করেন।

এই ঘটনাটি স্পষ্ট করে যে, মুহাম্মদ প্রাথমিক পর্যায়ে পৌত্তলিক সমাজকে তুষ্ট করতে ধর্মতাত্ত্বিক আপস করেন। তখন তিনি হয়তো বিশ্বাস করতেন যে, এই দেবতারা আছে, তবে আল্লাহ তাঁদের উপরে। ২৩:১৪ আয়াত সেই মনোভাবেরই অনুরূপ—একাধিক স্রষ্টা আছে, তবে আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।


মদিনায় “আল্লাহ” সত্তার রূপান্তর: একত্ব থেকে কর্তৃত্বে

মুহাম্মদের মদিনা পর্বে কোরআনের বক্তব্য ও আল্লাহর চরিত্রে একটি বিশাল রূপান্তর ঘটে। মক্কায় তিনি ছিলেন নিপীড়িত প্রচারক; মদিনায় তিনি হয়ে উঠেন রাজনৈতিক নেতা, সেনানায়ক ও বিচারক। এই পরিবর্তনের প্রতিফলন দেখা যায় কোরআনের ভাষায়ও। আল্লাহ এখানে হয়ে ওঠেন:

  • একমাত্র উপাস্য
  • সর্বশক্তিমান শাসক
  • যুদ্ধদাতা ও শাস্তিদাতা
  • আইনদাতা ও সমাজ নিয়ন্ত্রক

মদিনায় অবতীর্ণ কিছু উদাহরণ:

“আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনিই তত্ত্বাবধায়ক।”
—সূরা জুমার ৩৯:৬২

“আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, তিনি সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান।”
—সূরা আল-ইমরান ৩:৬২

“যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করবে, তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নাম দেওয়া হবে।”
—সূরা আন-নিসা ৪:১৪

“যুদ্ধ করো আল্লাহর পথে… হত্যা করো, শাস্তি দাও।”
—সূরা মুহাম্মদ ৪

এইসব আয়াতে আল্লাহ এখন আর “সর্বশ্রেষ্ঠ স্রষ্টা” নন—তিনি একচ্ছত্র ঈশ্বর, রাজা, সেনানায়ক। এমনকি তাঁর শত্রুরাও শাস্তির উপযুক্ত, শুধু তাওহিদের অস্বীকার করলেই।


ধর্মতত্ত্বের রূপান্তর কি প্রমাণ করে মানবিকতা?

উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে উঠে আসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—আল্লাহ কি একটি চিরস্থায়ী, ধ্রুব, সর্বজ্ঞ ঈশ্বর, নাকি একটি ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত ধারণা?

প্রাথমিক পর্যায়ে পৌত্তলিক আপস, হেনোথেইজম, “স্রষ্টাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ” বক্তব্য এবং পরবর্তীতে একচ্ছত্র শাসকের চিত্র—সব মিলিয়ে আল্লাহ একটি ধর্মীয় ধারণা যা মুহাম্মদের রাজনৈতিক বাস্তবতা, সামাজিক চাপ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে।


উপসংহার

সূরা মু’মিনুন ২৩:১৪ আয়াত কোরআনের অন্যতম বিভ্রান্তিকর ও স্ববিরোধী বাক্য। এটি কেবল ভাষার অস্পষ্টতা নয়, বরং ইসলামি ঈশ্বরতত্ত্বের অন্তর্নিহিত সংকটের প্রতীক। এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই—

  • মুহাম্মদের প্রাথমিক ধর্মপ্রচারে পৌত্তলিক বিশ্বাসের আপস,
  • ভাষাগতভাবে একাধিক স্রষ্টার অনুমান,
  • মক্কা ও মদিনা পর্বে “আল্লাহ” সত্তার দ্বৈত ও রূপান্তরিত চরিত্র,
  • কোরআনের একত্ববাদের দাবির সাথে মূলগত সাংঘর্ষিকতা।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ইসলামি ধর্মতত্ত্বে “আল্লাহ” কোনো চিরস্থায়ী পরম সত্য নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গঠিত চরিত্র, যার গঠনপ্রক্রিয়া ছিল ধর্মপ্রচারক মুহাম্মদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই নির্ধারিত।


📌 রেফারেন্স
((The Quran, 23:14))
((The Quran, 39:62; 35:3; 16:20; 11:1))
((Ibn Ishaq, Sirat Rasul Allah))
((al-Tabari, Tafsir al-Kabir; Tarikh al-Rusul wa al-Muluk))
((Fred Donner, Muhammad and the Believers))
((Patricia Crone, God’s Caliph))
((Wansbrough, Quranic Studies))
((Gabriel Said Reynolds, The Quran and the Bible))

Article Information
Author:user
Published:July 14, 2025
0
Categories:0